দেনা পাওনা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বুলিবদল: নিখিলেশ রায় Dena Pawna - Rabindranath Tagore

দেনা-পাওনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 
বুলিবদল: নিখিলেশ রায়  

পাচটা ব্যাটার পাছত যেলা একটা কইনাছাওয়ার জন্ম হইল বাপে - মাওয়ে খিব আদর করিয়া উনার নাম থুইলেক নিরুপমা । ইমার গােষ্ঠীত এমন শখিনদারী নাম ইনার আগােত শােনা নাই যায় । বেশিরভাগে ঠাকুর - দেবতার নামে নাম রাখিচে – গণেশ , কার্তিক , পার্বতী যেমন । এলা নিরুপমার বিয়ার আলাপ চলির ধরিচে । উনার বাপ রামসুন্দর মিত্র অনেক চান্দে বেড়ায় কিন্তুক পাত্র আর কোনােমতে মনের মতন হয় না । শেষত মস্ত এক রায়বাহাদুরের ঘরের এখেনামাত্র ব্যাটাক উকটি নিকিলাইচে । ঐ রায়বাহাদুরের বাপ - কালিয়া জাগা - জমিন যদিও এলা অনেক কমি আসিচেকিন্তুক পুরানি ধনী তাে হয় ! বরের বাড়ি থাকি দশ হাজার টাকা দাবী আর মেলা দানের জিনিসপাতি চায়া বসিল।রামসুন্দর আগপাছ কোনােয় না ভাবিয়া ঐ ঢাকে কথা দিয়া দিল ; এইটক পাত্র কোনােমতেয় হাতছাড়া করা না যায় । কোনােমতেয় আর টাকার জোগাড় হয় না । বন্ধক থুইয়া , বেচে দিয়া , অনেক চেষ্টা করিয়াও ছয় - সাত হাজার বাকি থাকিল । এ - পাকে বিয়ার তারিখ বগল আসি গেইচে । শেষত বিয়াওয়ের তারিখ আসিয়ায় গেইল । খুবে চড়া সুদ নিয়া একঝন বাকি টাকাগুলা ধার দিবার চাইচে কিন্তুক ঠিক সময়ে উনার দেখা পাওয়া গেইল না । বিয়ার মণ্ডপত একটা হুলুস্থুল কাণ্ড নাগি গেইল । রামসুন্দর আমার এই রায়বাহাদুরের হাত - ঠ্যাং ধরিয়া কইল , ‘ শুভকাজ শেষ হয়া যাউক , মুই অবশ্যয় টাকাটা শােধ করি দিম । রায়বাহাদুর কইল , ‘ টাকা হাতত না পাইলে বরক মণ্ডপত বসা যাবে না । ' এমন হাংহাট্টিত ভিতিরাবাড়িত কান্দাকাটি নাগি গেইল । এই মারাত্মক বিপদের মূল কারণ ঝায় উনায় বিয়ার চেলি পিন্দিয়া , গয়না পিন্দিয়া , কপালােত চন্দন মাখিয়া ঝিৎ করি বসি আছে । ভাবী শ্বশুরবাড়ির বাদে যে উনার খিব একটা ভক্তি বা ভালােবাসা জাগির ধরিচে , সেখেনা কবার না পাই । ইনারে ভিতিরা একেনা সুবিধা হইল । বর অচমকা উনার বাপের অবাধ্য হয়া উঠিল । উনায় বাপক কয়া দিল , ‘ কেনা - বেচা , দরদামের কথা মুই না বোেঝং , বিয়াও করির আসিচুং , বিয়াও করিয়া যাইম । ” বাপ যাকে দেখিল তাকেয় কইল , দেখিলেন বাহে , আজিকালিকার চ্যাংড়ালায় ব্যবহার । দুই - একঝন বুড়া মানষি আছিল , উমরা কইল , শাস্ত্রের শিক্ষা , নীতিশিক্ষা এক্কেরে নাই , কাজেয় । এলাকার শিক্ষার কুফল নিজের ব্যাটার মইধ্যত নিজের চক্ষুয় দেখিয়া রায়বাহাদুর ঠাস খায়া বসিরইলেক । বিয়াও একঢক মনখারাপ আর নিরানন্দতে শেষ হয়া গেইল । শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় নিরুপমাকবুকত টানি নিয়া বাপ আর চখুর জল বান্ধি রাখির পাইলেক । নিরু পুছিলেক , ‘ উমরা কি আর মােক আসির দিবেনা , বাবা।’রামসুন্দর কইলেক , ‘ কেনে আসির দিবে না মা । মুই তােক ধরি আসিম । রামসুন্দর হরদম বেটিক দেখির যায় । কিন্তুক বিয়াইবাড়িত উনার কোনয় হাকডেক নাই । চাকরগুলা পর্যন্ত উনাক নিচানজরত দেখে । বায়রাবাড়ির একটা অইন্য ঘরত পাচমিনিটের বাদে কোনােদিন - বা বেটিক দেখির পায় , কোনােদিন - বা দেখিরে পায় না । সাকাইবাড়িত এমন করিয়া অপমান তাে সহ্য করা না যায় । রামসুন্দর ঠিক করিল , য্যাঙ করিয়া হউক টাকাটা শােধ করি দেওয়া খাবে । কিন্তুক যত ধারদেনা ঘাড়ত চাপিছে , ওইলার ভরিয়ে সহ্য করা না যায় । খরচপাতির খিব টানাটানি পড়িছে ; আর পাওনাদারের চকুত যাতে না পড়ে সেইজন্যে সউগসমায় কত নাকান হীন চাল্লাকি নিয়া যে চলির ধরিচে । এপাকে শ্বশুরবাড়িত উঠিতে - বসিতে বেটিক খােটা খাওয়া খায় । বাপেরবাড়ির নিন্দা শুনিয়া ঘরের দেয়াের বন্ধ করি চখুর জল ফেলা উনার পত্তিদিনের কাজ হয় গেইচে । বিশেষ করি শ্বশুড়ির হমক - দমক আর কিছুতেয় মেটে না । যদি কাঙো কয় , “ আহা কী সুন্দর । বৌয়ের মুখখান দেখিলে চক্ষু জুড়ি যায় । শ্বশুড়ি ঝামড়ে উঠি কয় , ইস্ কী ঢক ! যেমন ঘরের কইনা , তেমন সুন্দর । এমন - কি বৌ - য়ের খাওয়া পেন্দারও যতন না হয় । যদি কোনাে দয়ালু আশপড়শি অযতনের কথা পাড়ে , শ্বশুড়ি কয় , ‘ ঐলায় মেলা হইচে । মানে হইল , বাপ যদি পুরা দাম দিলেক হয় তা হইলে বেটিও পুরা যতন পাইল হয় । সগায় এমন ভাব দেখায় যেনে বৌয়ের এটেখুনা কোনােয় অধিকার নাই । ফাকি দিয়া এই বাড়িত ঢুকিছে । বােধায় বেটির এইনাকান অনাদর আর অপমানের কথা বাপের কানত যায়া উঠিছে । সেইজন্যে রামসুন্দর শেষত ভিটামাটি বেচে দিবার চেষ্টা করির ধরিল । কিন্তু ব্যাটালাক যে বাড়িছাড়া হওয়া খাবে সেই কথাটা উমারটেখুনা গােপন রাখিলেক । ঠিক করিচে , বাড়ি বেচেয়া সেই বাড়ি ভাড়া নিয়া রবে , এমন চালাকি করিয়া চলিবে যে , উনার মরিবার আগত এই কথাটা ব্যাটাগুলা জানিরে পাবে না । _ কিন্তুক ব্যাটালা জানি ফেলাইল । সগায় আসি কান্দিকাটি পড়িল । বিশেষ করি বড় তিন ব্যাটারে বিয়াও হইচে আর উমার কারাে বা ছাওয়াছােট হইচে । উমার আপত্তি খিব মারাত্মক হয়া উঠিল । বাড়ি বেচা বন্ধ হইল । সেলা রামসুন্দর নানানঠে হাতে চড়া সুদত অল্প অল্প করি টাকা ধার করিবার ধরিল । এমন হইল যে , সংসারের খরচা আর চলে না । নিরু বাপের মুখ দেখিয়া সউগ বুঝির পাইল । বুড়ার পাকা চুলিত , শুকান মুখত আর সউগসমায়ের স্যাও হয়া - থাকা মাইমুসুরি ভাবত দারিদ্র্য আর দুশ্চিন্তা বির হয়া গেইল । বেটিরঠে বাপ যেলা দুষী সেলা সেই দোষের অনুতাপ কি আর ঢাকি থােওয়া যায় । রামসুন্দর যেলা বেয়াইবাড়ির অনুমতি নিয়া খানিক সমায়ের বাদে বেটির দেখা পায় , সেই সময় বাপের বুক যে ক্যাঙ করিয়া ফাটে , সেটা উনার হাসি দেখিলেয় টের পাওয়া গেইছে । সেই দুঃখী বাপের মনক সান্ত্বনা দিবার বাদে কয়দিন বাপের বাড়ি যাবার বাদে নিরু খিব অস্থির হয়া উঠিছে । বাপের দুখিয়া মুখখান দেখিয়া উনায় আর দূরত থাকির পায় না । একদিন রামসুন্দরক কইল , “ বাবা , মােক একবার বাড়ি ধরি যা । রামসুন্দর কইলেক , ‘ আচ্ছা । কিন্তুক উনার কোনাে জোর নাই — নিজের বেটির উপুরা বাপের যে স্বাভাবিক অধিকার আছে , ওইটা যেনে দাবীর টাকার বদলে বন্ধক থুইয়া দিছে । এমনকি বেটির দেখা - পাওয়া , সেটাও খিব জড়ােসড় হয়া ভিক্ষা চাওয়া খায় আর কোনাে কোনাে সময় নিরাশ হইলে , দোসরা কথা কওয়ায় মুখ থাকে না । কিন্তুক বেটি নিজে বাড়ি আসির চাইলে বাপ উনাক না আনি ক্যাঙকরি থাকে । সেইজইন্যে বিয়াইরঠে সে সমন্ধে দরখাস্ত পেশ করির আগত রামসুন্দর কত হীনতা , কত অপমান , কত ক্ষতি স্বীকার করিয়া যে তিনখান হাজার টাকা জোগাড় করিচে , সেই ইতিহাস ফাস না করায় ভালাে । নােট কয়খান রুমালত প্যাচেয়া চাদরত বান্দিয়া রামসুন্দর বিয়াইয়ের গােড় যায়া বসিল । পথমে হাসিমুখ করি টারিবাড়ির খবর পাড়িলেক । হরেকৃষ্ণর বাড়িত একটা বড়সড় চোর হয়া গেইচে , তার গােড় হাতে ইতিহাসখান কইলেক । নবীনমাধব আর রাধামাধব দুই ভাইয়ের তুলুনা করিয়া বিদ্যাবুদ্ধি আর স্বভাব বিষয়ে রাধামাধবের প্রশংসা আর নবীনমাধবের নিন্দা করিলেক ; টাউনত একটা নয়া রােগ আসিছে , সে বিষয়ে ভালেগুলা আজগুবি কথা পাড়িলেক , শেষত হুকাটা নামে থুইয়া কথায় কথায় কইলেক , ‘ হা হা , বিয়াই সেই টাকালা বাকি আছে না ; পত্তিদিনে ফমকরাং যাইম যখন হাতত করি কিছু নিয়া যাং ; কিন্তুক ঠিক সময়ে ফম থাকে না । আর ভাই , বুড়া হয়া গেচুং । এমন একটা দীঘিলা ভূমিকা করি , পাজরের তিনখান হাড্ডির নাকান সেই তিনখান নােট দেখন খিব সহজে খিব অবহেলাত বাইর করিলেক । সবমিলি মাত্র তিনহাজার টাকার নােট দেখি রায়বাহাদুর হাে হাে করি হাসি উঠিল । কইলেক , ‘ থাউক বিয়াই , ওইলার মাের দরকার নাই । একটা চলতি বাংলা প্রবাদের কথা তুলি কইলেক , সামান্য কারণত হাত গােন্ধ করির উনায় না চায় । এই ঘটনার পাছত বেটিক বাড়ি আনির প্রস্তাব কারাে মুখত আইসে না — খালি রামসুন্দর ভাবিলেক , সেই সব সাকাইগিরির সংকোচ মােক আর শােভা পায় না । মনত খিব আঘাত পায়া খানিক সমায় ঝিৎ করি থাকিয়া শেষত মিনমিন করিয়া কথাটা পাড়িলেক । রায়বাহাদুর কোনােয় কারণ তুলিয়া কইলেক , ‘ সে এলা হবে না । এই কথা কয়া দোসরা কাজত অইন্য জাগাত চলি গেইলেক । রামসুন্দর বেটিরঠে মুখ না দেখেয়া কাপা হাতে কয়খান নােট চাদরের কানিত বান্দিয়া বাড়ি ফিরি গেইলেক । মনে মনে কিড়া কাটিলেক , যদ্দিন না সউগ টাকা শােধ করিয়া দিয়া অসংকোচতে বেটির উপুরা দাবী করির পাবে , তদ্দিন আর বিয়াইবাড়ি যাবে না ।। ভালেদিন চলি গেইল । নিরুপমা মানষির উপুরা মানষি পাঠায় কিন্তুক বাপের দেখা পায় না । শেষত অভিমান করি মানষি পেঠা বন্ধ করি দিল — সেলা রামসুন্দরের মনত খিব আঘাত নাগিলেক । কিন্তুক তবু গেইলেক না । আশ্বিন মাস আসিল । রামসুন্দর কইলেক , ‘ এবার পূজার সমায় মাওক ঘরত আনিমে , না হইলে মুই ’ — খুব করি একটা শক্ত চায়া কিচ্ছা কাটিলেক । পঞ্চমী না ষষ্ঠীর দিন ফির চাদরের কানিত কয়খান নােট বান্দিয়া রামসুন্দর যাবার বাদে রেডি হইল । পাচ বছরিয়া এক নাতি আসি কইল , “ দাদা মাের বাদে গাড়ি কিনির যাবার ধরিচিস ? ভালেদিন থাকিঠেলাগাড়িত চড়ি উনার হাওয়া খাবার শখ হইচে । কিন্তু কোনােমতে সেটা মেটেবার উপায় হবার ধচ্ছে না । ছয় বছরিয়া এক নাতিনি আসি কান্দিতে কান্দিতে কইল , পূজার নিমন্তণত যাবার নাকান উনার একখানও ভাল শাড়ি নাই । রামসুন্দর সেটা জানে । তবে সেই সমন্ধে তামুক খাইতে খাইতে বুড়া মেলা চিন্তা করিচে । রায়বাহাদুরের বাড়ি যেলা পূজার নিমন্ত্রন হবে , সেলা উনার বৌলাক খিবে সামান্য গয়নাগাটি পেন্দেয়া দয়া করার নাকান গরীবের মতন যাওয়া খাবে । এইলা কথা ফম করি উনায় অনেক দীঘিলা নিকাশ ফেলাইচে । কিন্তু তাতে উনার কপালের গােটো - হওয়া দাগগুলা আরাে ডবডবা হওয়া ছাড়া আর কোনাে ফল নাই হয় । দারিদ্র্যত জর্জরা হওয়া বাড়ির কান্দনের সুর কানত ধরি বুড়া উনার বিয়াইয়ের বাড়ি যায় ঢুকিলেক । আজি আর উনার সেমন জড়ােসড় ভাব নাই ; দারােয়ান আর চাকরবাকরগিলার মুখের ভিতি সেইনইজ্যানইজ্যা চউখের চাউনি আরনাই , দেখন নিজের বাড়িত যায়া ঢুকিলেক । শুনিলেক , রায়বাহাদুর বাড়িত নাই , খানিক বাচ্চে রওয়া খাবে । মনের হুলাস চাপে থুবার না পায়া রামসুন্দর বেটির সােদে দেখা করিলেক । আনন্দতে দুই চখু দিয়া জল পড়ির ধরিল । বাপও কান্দে , বেটিও কান্দে ; দুইঝনের কাঙো আর কথা কবার পায় না । এ্যাঙ করিয়া খানিকক্ষণ চলি গেইল , তার পাছত রামসুন্দর কইলেক , এবার তােক নিয়া যাইম মা , আর কোনােয় ভুল নাই । এমন সময় রামসুন্দরের বড় ব্যাটা হরমােহন উনার দুইটা বাচ্চা ব্যাটাক ধরি অচমকা ঘরত আসি ঢুকিল । বাপক কইল , ' বাবা , আমাক তা হইলে এবার ঘাটাত বসালু ? রামসুন্দর অচমকায় জ্বলি উঠিয়া কইলেক , তােমার বাদে কি মুই নরকত যাইম । মােক তােমরা মাের সইত্য পালন করির দিবেন না ? ’ রামসুন্দর বাড়ি বেচেয়া বসি আছে ; ব্যাটালা কোনােমতে জানিবার না পায় , তার অনেক ব্যবস্থা করিছিল । কিন্তুক ত্যাঙো উমরা জানির পাইছে দেখিয়া , উমার উপুরা হঠাৎ খিব রাগ আর অধৈয্য হয়া উঠিল । 
উনার নাতি উনার দুই হাটু জোরে জাপটে ধরিয়া মুখ তুলি কইল , “ দাদা , মােক গাড়ি কিনি দিলু না ? ” মাথা নিচা - করি থাকা রামসুন্দরেরঠে ছাওয়াটা কোনাে উত্তর না পায়া নিরুর পােড় যায় কইল , ‘ পিসিমা , মােক একখান গাড়ি কিনি দিবু ? নিরুপমা সউগ ব্যাপার বুঝির পায়া কইল , “ বাবা , তুই যদি আর এক পাইসা মাের শ্বশুরক দিস , তা হইলে আর তাের বেটিক দেখির পাবু না , এই তাের গাও নাড়িয়া কলুং । রামসুন্দর কইলেক , ‘ ছিঃ মা , অমন কথা কবার না পাই । আর এই টাকাটা যদি মুই না দিবার পাং তা হইলে তাের বাপের অপমান । আর তােরও অপমান । নিরু কইলেক , ‘ টাকা যদি দিস তা হইলেয় অপমান । তাের বেটির কি কোনাে মর্যাদা নাই । মুই কি খালি একটা টাকার থলি , যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ মাের দাম । না বাবা , এই টাকা দিয়া তুই মােক অপমান করিস না । তাছাড়া তাের জাঙোই তাে এই টাকা চায় না । রামসুন্দর কইলেক , ‘ তা হইলে তােক যাবার দিবে না , মা । নিরুপমা কইলেক , না দেয় তাে কি করিম ক । তুইও আর নিয়া যাবার না চাইস । রামসুন্দর কাপা হাতে নােট - বান্ধা চাদরখান ঘাড়ত তুলিয়া ফির চোরের নাকান সগারে চখু এড়েয়া বাড়ি ফিরি গেইল । কিন্তুক রামসুন্দর এই যে টাকা আনিচে আর বেটির বাধাত সেই টাকা না দিয়া বাড়ি চলি গেইচে , সেই কথা গােপন থাকিল না । কোনাে কৌতূহলী স্বভাবের চাকরানী দোয়ােরত কান নাগেয়া শুনি নিরুর শ্বশুরিক এই খবর দিলেক । শুনিয়া উনার আর আক্রোশের সীমা থাকিল না । নিরুপমারঠে উনার শ্বশুরবাড়ি তীরের বিছিনা হয়া উঠিল । এপাকে উনার বর বিয়ার অল্পদিন । পাছত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়া বৈদেশ চলি গেইছে ; আর পাছে সঙ্গদোষে বেয়া শিক্ষা হয় , এই বাহানাত এলা বাপের বাড়ির সাকাইসােদরের সােদে নিরুর দেখা করা একেবারে বাদ হয়া গেইছে । এই সময়ে নিরুর একটা মারাত্মক অসুখ হইলেক । কিন্তুক সেইজন্যে উনার শ্বশুরিক সউগ দোষ দেওয়া না যায় । দেহার উপুরা উনায় খিব অবহেলা করি থাকে । কাতি মাসের শীত পড়ার সময় সারারাতি শিথানপাকে দুয়াের খােলা , জারের সমায় গাত কাপড় নাই । খাবার - দাবারের নিয়াম নাই । চাকরাণীলা যেলা মাঝে মাঝে খাবার আনির কথা ভুলি গেইচে , সেলা যে উমাক একবার মুখ খুলি ফম করি দেওয়া , সেখেনাও উনায় করে নাই । উনায় যে পরার বাড়ির চাকর - চাকরাণী আর গিরি আর গিত্যানীর দয়ার উপুরা এই বাড়িত আছে , এই ধারণা উনার মনত গাড়িয়া বসিচে । কিন্তুক এইটক ভাবনাও শ্বশুরির সইয্য হয় নাই , যদি খাবার - দাবারের ভিতি বৌয়ের কোনাে অবহেলা দেখিচে , তা হইলেশ্বশুরিকইচে , ‘ নবাবের বাড়ির বেটি তাে , গরীবের বাড়ির ভাত কিউনার মুখত রােচে ? ’ কোনােবেলা বা কইচে , “ দেখ না , একবার ছিরি হইচে দেখ না , দিনে দিনে দেন ছােবাখুটা হবার ধরিচে । অসুখ যেলা মারাত্মক হয়া উঠিল সেলা শ্বশুরি কইলেক , উনার সউগে ঢং । শেষত একদিন নিরু মাথা নিচা করি শ্বশুরিক কইল , বাবা আর মাের ভাইগুলাক একবার দেখিম , মা । শ্বশুরি কইলেক , ‘ খালি বাপের বাড়ি যাবার ছলনা । ” কাঙো কইলে বিশ্বাস করিবে না— যেদিন সইন্ধ্যার সমায় নিরুর শ্বাস উঠির ধরিল , সেইদিন পথম ডাক্তার দেখিলেক , আর সেইদিনে ডাক্তারের দেখা শেষ হইলেক । বাড়ির বড় বৌ মরিচে , খুব ধুম করি কাম শেষ হইল । ঠাকুর ভাসেবার আয়ােজন সমন্ধে জেলার ভিতিরা রায়চৌধুরীঘরের যেমন মানষির মুখে মুখে সুনাম আছে , বড় বৌয়ের সৎকার সমন্ধে রায়বাহাদুরঘরের তেমনে একটা নাম ফাটি গেইল — এমন চন্দনখুটার চিতা এইমুলুকত কাঙো কোনােদিন দ্যাখে নাই । এমন ধুমধাম করিয়া কাম খালি রায়বাহাদুরঘরের বাড়িতে হবার পায় আর শােনা যায় , ইনাতে উমার খানিকটা ধারদেনাও হইছে । রামসুন্দরক সান্ত্বনা দিবার সমায় উনার বেটি যে কেমন জইজোগারে মরিচে , সগায় তাকে খিব করি ভাঙি কইল । এপাকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চিঠি আসিল , ‘ মুই এটেখুনা সউগ ঠিকঠাক করি নিচুং , তায় দেরী না করি মাের বৌও - ক এটেখুনা পাঠে দেও । ' রায়বাহাদুরের গিত্যানী লেখিল , বাবা , তাের বাদে আর এখেনা কইনা দেখিচি , তার বাদে দেরী না করি ছুটি নিয়া এটেখুনা আইসেক । এইবার বিশ হাজার টাকা দাবী , আর হাতে হাতে আদায় ।

1 Comments

Previous Post Next Post