নিষ্কলঙ্ক বত্তের কথা - সুচন্দ্রা ভট্টাচার্য লৌকিক গল্প Nishkalonka batter katha - Suchandra bhattacharya

নিষ্কলঙ্ক বত্তের কথা 
সুচন্দ্রা ভট্টাচার্য

এক সদাগর । সদাগর একবার করি বিয়াও করে আর স্যালায় রাজারটে হাতে বাণিজ্যের খবর আইসে । স্যালা সদাগর বাণিজ্যৎ যায় আর উমার বৌটা কুলটা হয় । একে একে ছয়বার বিয়াও করিল । বিয়াও করে , বাণিজ্যর খবরও আইসে । ছয় ছয়টা বৌয়ে কুলটা হয়া যায় । ইয়াতে সদাগরের মনৎ খিব দুঃখ হইল । সদাগর স্যালা আর বিয়াও করিম না ’ কয়া কিরা কাটিল । একদিন সদাগর ভ্যাটা খেলে বেড়ায় । ভ্যাটাকোনা এক মালীর বাড়িৎ পড়িল যায় । সদাগর কইল , “ বাড়িৎ কায় আছেন, মোর ভ্যাটাকোনা বাইর করি দেও । বাড়িৎ একনা বুড়ি আর উয়ার একনা নাতনি থাকে , বুড়ি সেলা বাড়ি নাই , নাতনি ঠ্যাং দিয়া ভ্যাটা কোনা বাইর করি দিল । সদাগর দেখিল উয়ার ঠ্যাং কোনার কী সুন্দর ঢক ! সদাগর কয় , না জানােং কইন্যাটার আরাে কেমন রূপ । সদাগর বাড়ি যায়া মাক কইল , “ ঐ বুড়ির বাড়ি একনা কইন্যা আছে , মুই উয়াকে বিয়াও করিম । সদাগরের মাও মালীর বাড়ি যায়া কইল , বুড়ার বেটি , তাের নাতনিকোনাক দে , মাের ছাওয়াক দিয়া বিয়াও দেং । বুড়ি কয় , মুই গরীব মাষি , তােমরা যদি মাের নাতনিকোনাক বউ - স্যাদান তা হইলে তাে ভাল হয় । সদাগর দিন - বার ঠিক করিল । খরচাপাতি করি ঐ কইন্যাক বিয়াও করিল । দুইদিন পাছৎ সদাগরের বাণিজ্যর খবর আসিল । সদাগর সেলা কয় , এতদিন বিয়াও করােং নাই বাণিজ্যর খবরও আইসে নাই । বিয়াও করনুং বাণিজ্যের খবরও আসিলেক । সেলা সদাগর কি করে , একখান আঠারাে হাত উঁচা করি টংসি বানাইল । তার পাছৎ সুন্দর করি সাউদানিক সাজাইল । কোচার মুটি শাড়ি পেনদেয়া সীতাৎ সেন্দুর দিয়া ঐ আঠারাে হাত টংসির উপুরা তুলি থুইল । আর উয়ার মাক কইল , ' মা মুই বাণিজ্যৎ যাইম , তাের বউয়ােক তুই উপুরা থাকি নামাইস না , যতদিন মুইনা আইসসাং । কী খায় কী না খায় সউগ ঐটে দিবু । আর কোনােটে যাবারও দিবু না । এই কথা কয়া সদাগর বাণিজ্যৎ গেইল । ইদি পুষ মাসে আমাসি নিষ্কলঙ্ক পূজা আসিল , আগের দিন সগায় হাটোৎ খরচ - পাতি করে ।। মালিনী বুড়িও হাট গেইচে । বুড়ি কয় , ‘ ঐলা কি করিবেন ? ’ মানষিগুলা কয় , “ তােমরা আরো জানেন না ? কালি আমাসি নিষ্কলঙ্ক পূজা । কলঙ্কিয়া ঘরৎ তােমার নাতনিক দিচেন , খরচাপাতি করি নিয়া যান , নিষ্কলঙ্ক পূজা করিলে তােমার আর কলঙ্ক হবে না । বুড়ি স্যালা দৈ , চুড়া , কলা , কুসিয়ার , বাতেসা কিনিল । ঐলা নিয়া উয়ার নাতনিরটে গেইল । ঐলা নাতনিক দিয়া কইল , “ কালি নিষ্কলঙ্ক পূজা হবে , পূজাপানি করিস তেই নিষ্কলঙ্কে কাল যাবে । নাতনি কয় , ‘ এ্যা , আঠারাে হাত টংসির উপুরা আছুং ঐটে আরাে মাের কিসের কলঙ্ক ? কী আনচি দে । ” এই কথা কয়া যেগুলা খাবার জিনিস খাইল , যেগুলা খাওয়া না - যায় ওগুলা দুই ঠ্যাং দিয়া খচিয়া ফেলে দিল । উয়ার কাণ্ড দেখিয়া নিষ্কলঙ্ক বাসুদেব ঠাকুরের খং উঠি গেইল । ঠাকুর মনে মনে কয় , তাের এত বড় অহংকার , তাের কলঙ্ক হয় , দেখােং তাের কেমন কলঙ্ক না হয় ? এই কয়া লক্ষ্মীবাসুদেবঠাকুর সাউদানীর ঘরৎ গেইল । পানের বাটা থাকি পান খাইল , সাউদানীর শিতান পাকে পানের পিচকি ফেলাইল , পাওয়ের পাছ দিয়া মুতিল । মােতার জাগাৎ নাপা আর বতুয়া শাক হইল , পানের পিচকির জাগাৎ ডাঙা শাক হইল ।। পাছাদিন সকালে সাউদানীর নননে যায়া সাউদানীক কইল , “ বৌ , আজি কী দিয়া ভাত খাবু ? সাউদানী ডাঙা শাক , নাপা শাক আর বতুয়া শাক তুলি দিয়া কইল , “ ঠাকুরানীক কইস আদা গাজি দিয়া বতুয়া শাক , ডাঙা শাক ভাজা আর কামরাঙা দিয়া নাপা শাকের টক রান্ধি দেয় যেনে । ননন শাক নিয়া মা’ক কইল , “ আঈ আঈ , তাের বৌয়ের এইলা খাবার শখ হইছে ! বুড়ি রান্দিয়া বেটির হাত দিয়া পাঠাইল । সাউদানী ওগুলা খায়া লক্ষ্মীবাসুদেবের মায়াতে গাওভরা হইল । পরের দিন ননন আসি পােচে , “ বৌ আজি কী খাবু ? ’ সাউদানী কইল , “ আজি মনটা বয়া নাগচে । একনা আদা , নুন আর ঝেয়ার জল । ননন যায় এই কথা মা’ক কইল । মাও কয় , ‘ খাবে নাতেন কি , যেই হাতে করি দেই সেই হাতে খায় । এমন করি পাচ মাস গেইল । ননন যায়া পােচে , ‘ বৌ আজি কী খাবু ? বৌ কয় , ‘ আজি গােসানীক কইস , একবাটি পঞ্চামৃত আর এক থাল পরমান্ন খাবার হাউস হইচে । ননন এই কথা শুনি মা’ক যায়া কইল । বুড়ি স্যালা দুধ আনিল , দৈ আনিল । তার পাছৎ পঞ্চামৃত আর পরমান্ন রান্দিয়া বেটির হাত দিয়া পাঠে দিল । সাউদানী হাউস মিটিয়া ওগুলা খাইল । এ্যাং করি সাত মাস হইল । সেদিনও যায়া ননন পােচে , বৌ আজি তুই কী খাবু ? ’ সাউদানী কয় , ঝালা - গুড়া , মিঠা - গুড়া , পিঠা , নুচি , মিষ্টি এগুলা খাবার মন যায় । ননন যায়া মা’ক সউগ কইল । বুড়ি স্যালা সউগ কিনি আনিয়া এগুলা বানেয়া বেটির হাত দিয়া পাঠাইল । বুড়ি কিন্তুক একদিনও টংসিৎ যায় না । এ্যাং করি নয় মাস হইলে ননন যায়া পুছ করিল , ‘ আজি কী খাবু বৌ ? ’ সাউদানী কয় , ‘ মাছ , মসসাং , ডিমা , ভাজা , বড়া , নয়টা জিনিস দিয়া ভাত খাবার হাউস হয় । সেদিনও ননন যায়া মাকৈ কইল সউগ কথা । বুড়ি ঐলা রান্দিয়া বেটির হাত দিয়া পাঠে দিল । সাউদানী পেট ভরেয়া হাউস মিটি খাইল । তারপর যায়া পড়িল দশ মাসত , কুত্তি বা গেইল বৌয়ের চক্ষুর কাজল , কোটে বা গেইল সীতার সেন্দুর আর কোটে বা গেইল উয়ার কোচা মুটি শাড়ি । সেদিন ননন যায়া পুচিল , বৌ , আজি কী খাবু ? ’ সাউদানী কয় , “ ঠাকুরানীক কইস আজি আর কিছুই খাবার ইচ্ছা নাই । আজি একটা মুচি - মাটি আর দুইটা আটিয়া কলা আনি দিস । তাক খাইম । সেদিন ননদ বাড়ি যায়া কয় , “ আঈ আঈ , তুই তাে কোনােদিন যাইস না , দেখিসও না তাের বৌ কিবা ঢক হইচে । কোটে বা গেইচে সীতার সেন্দুর , কোটে বা গেইচে নয়নের কাজল আর কোটে বা গেইচে কোচা মুটি শাড়ি । একনা ঢুসুরী পারা বেটিছাওয়া হইচে । আজি আরাে খাবার চাইচে আটিয়া । কলা আর মুচি - মাটি । এই কথা শুনি বুড়ি মাথাৎ চাপড়ায় , কপাল চাপড়ায় আর কয় ‘ কোটে থাকি মুচি খাওয়া দেও আসিল ? নিচ্চয় বা বৌয়ের কি হইছে । ' এই না কয়া বুড়ি টংসিত চড়িয়া ছাড়ে সাউদানিক পাড়ি আনিল । যে জন্যে মাের ছাওয়ার আঠারাে হাত টংসির উপুরা তােক থােওয়া , তাের হুনা সেই হইছে ? এই কথা কয়া বুড়ি উয়াক নামে নিয়া গেইল । ইদি সদাগর আসিল বাণিজ্য থাকি । ঘাট নৌকা লাগেয়া বাড়িৎ খবর পাটে দিল — ‘ মা’ক আর বৌয়ােক আসিয়া ডিঙা বরি নিবার কন । পাইক আসি বুড়িক কইল , ‘ সদাগর আসিছে , তােমাক আর বৌওক ঘাটৎ যায়া ডিঙা বরির কইল । সদাগরের মাও কয় , “ বৌয়ের অসুক হইচে , বৌ যাবার পাবে না । পাইক এই কথা যায় সদাগরক কইল । সদাগর কইল , “ দোলাৎ করি আনির কন । পাইক যায়া বুড়িক দোলাৎ করি বৌ আনির কইল । বুড়ি স্যালা কইল ‘ বৌ মামার বাড়ি গেইচে । পাইক যায় এই খবর দিল । স্যালা সদাগর ভাবে , এত আল কেনে , নিশ্চয় কোনাে কিছু হইচে । স্যালা সদাগর পাইক কইল , মামার বাড়ি থাকি ধরি আসির কন যায় । পাইক যায়া বুড়িক কইল , সদাগর খুব রাগি গেইচে । যেটে হাতে হয় সেটে হাতে বৌওক নিয়া দোলাৎ চড়িয়া ঘাট যাবার কইল । বুড়ি স্যালা কী করে , বৌওক একখান দশহাতি কাপড় পেয়াে দোলাৎ চড়েয়া দুইখান দোলাৎ দুইঝনে চড়িয়া নদীর ঘাট যাবার ধরিল বুড়ির দোলা আগে আগে যায় আর সাউদানীর দোলা অনেক পাছে পাছে আইসে । সদাগর দেখিয়া কয় “ আচ্ছা , মা হইল বুড়া মানষি । তার দোলা আইসে আগে আগে , আর সাউদানী হইলেক ছাওয়া মানষি , তার দোলা কেনে অত ধীরে ধীরে আইসে । মুই বুঝচুং ইয়ারও বা হইচে কী । দোলা দুইখান য্যালা আসিল স্যালা সদাগর কয় , “ মা , যা হবার তা হইছে । মুই সউগে জানােং । য্যালায় বিয়াও করােং স্যালায় বাণিজ্যর খবর আইসে । মুই যাং বাণিজ্যৎ আর বৌ হয় কুলটা । মুই আর বাড়ি যাইম না । একভাগ ধন কড়ি তুই নিয়া যা । বইনিক বিয়াও দিস আর বাকী ধন কড়ি মুই সাতদিন ধরি বিলাইম । সাতদিন পরে মুইও মরিম , সাউদানীকও মারিম । তুই যতদিন বাঁচি রবু , ধন সম্পত্তিলা দিয়া খাই । বুড়ি আর কী করে , কান্দিকাটি বাড়ি গেইল । মাও বাড়ি গেইলে সদাগর একেনা মস্তবড় জুইয়ের কুণ্ড খােড়াইল । সাতদিন ধরিটাকপাইসগুলা দান দক্ষিণা করিল । সাতদিনের দিন তাে উয়ায় জুইয়ােত ঝাপেয়া মরিবে । এইলা না দেখিয়া লক্ষ্মীবাসুদেব ঠাকুর কয় , ' আচ্ছা , এই যে নিদূষী সদাগর সাতদিন ধরি দান দক্ষিণা করির ধইচ্চে , আজি তাে উয়ার মরিবার দিন । সাউদানীক মারিবে উয়ায়ও মরিবে । সাউদানীটা মরে মরুক , ওটা তাে অহঙ্কারী । কিন্তু এই যে নিদূষী সদাগর মরিবে , তার তাে মরার ভাগ মােরে ঘাড়ৎ পড়িবে । তা যাই হউক , উয়াক বাচের নাগিবে । আর উয়ায় না বাচিলে তাে মাের পূজা প্রচারে না এই ভাবিয়া একটা বুড়া বামুন হয়া সদাগরেরটে গেইল । সদাগরােক যায়া কয় , ' বাবা অনেক দান - দক্ষিণা করির ধচ্চেন , মােকো কিছু ভিক্ষা দেও । ' সদাগর শুনিয়া কয় , ‘ বামুন ঠাকুর , আজি সাতদিন ধরি দান দক্ষিণা করােং , আর তাে কিছুই নাই । এলা তাে মাের মরিবার সমায় হইচে । এলা তাে মুই জুইয়ের কুণ্ড ঝাপেয়া মরিম । ঠাকুর কয় , “ কেনে বাবা মরিবেন ? ' সদাগর কয় , ‘ মাের মনৎ বড় দুঃখ । এক এক করি ছয় বিয়াও করিলােং আর বাণিজ্যর খবর আইসে । মুই বাণিজ্য করিবার যাং আর বৌগুলা কুলটা হয়া যায় । তারপরে একনা আটবছরী কইন্যাক বিয়াও করনুং তাও হয়া গেইল কুলটা । এই দুঃখে আজি এই জুইয়ের কুণ্ডৎ উয়াক ফেলে দিম , মুইও ঝাপাইম । ঠাকুর কয় , এটা আরও কি কথা , আট বছরী ছাওয়ার কি আর কলঙ্ক হয় ? পাছে বা কোনাে অসুখ হইচে । মােক খানেক দেখাইলে দেখনুং হয় । সদাগর কয় ‘ দেখির পান , কিন্তুক তাড়াতাড়ি দেখ । মাের মরিবার সমায় বয়া যায় । ঠাকুর কয় , ‘ একনা খ্যাড়ের ভূতি দেও , দুকনা শুকাতি দেও , একনা শিল আর গাওয়া ঘিউ দেও । আর একনা কাপড় ঘিরাও করি দেও । সদাগর স্যালা হুকুম করিয়া সউগ জিনিস যােগাড় করি দিল । ঠাকুর স্যালা সাউদানীক ধরিয়া ঐ কাপড়ের ঘেরাওয়ের ভিতিরা ঢুকিল । ভূতিকোনা জুলেয়া শুকাতি বেশােয়ার ভূতি দিল , আর ঠাকুর ঘিউ নগুলাে নিয়া জুইয়ােৎ গরম করিয়া আগােত নিজের নাষ্টি , পাছােৎ সাউদানীর নাষ্টি সেকিল । এমন করি সাতবার সেকিল । স্যালা সাউদানী আগেরে মতন আটবছরী ছাওয়া হইল । সীতার সেন্দুর , নয়নের কাজল , কোচা মুটি শাড়ি সউগ আগের মতন হইল । স্যালা ঠাকুর ঊয়ার গালােৎ চড় দিয়া কইল , ‘ তাের বােলে কলঙ্ক না হয় ? এলা কেনে তাের কলঙ্ক হয় ? নিষ্কলঙ্ক ঠাকুরােক না চিনিয়া তাের এই দশা । এই কথা কয়া উয়ার কাপড়ের আচলাৎ পূজার বিধি নেখি দিয়া কইল , ‘ এই নাকান করিয়া পুষ মাস আমাসীর দিন নিষ্কলঙ্ক পূজা করিস , তাের কোনােদিন কলঙ্ক হবে না । আর সগাক জানে দিস্ , সগায় যেনে এই পূজা করে , তা হইলে সগারে নিষ্কলঙ্কে কাল যাবে । সদাগর কাপড়ের আচলাৎ দেখি সউগ বুঝিল । স্যালা সাউদানীক নিয়া বাড়ি গেইল । বাড়ি যায়া মারটে টাকা পাইসা নিয়া খরচা - পাতি করিয়া তার পাছ দিনে লক্ষ্মী বাসুদেবের পূজা সাউদানীক দিয়া করাইল । ঘট পাতালী ভাসাইল । পসাদ - পানি বাটি দিল । স্যালা থাকি সাউদানীর নিষ্কলঙ্কে কাল যায় । স্যালা থাকি পিথিবীত নিষ্কলঙ্ক পূজা প্রচার হইল ।

Post a Comment

Previous Post Next Post