কলীন্দ্রনাথ বর্মণ : একেনা বড় মানষিক নিয়া দুখুনা ছোট কথা —ড. নিখিলেশ রায়

কলীন্দ্রনাথ বর্মণ : একেনা বড় মানষিক নিয়া দুখুনা ছোট কথা
ড. নিখিলেশ রায়

সমাজত মাঝে মাঝে এক একঝন এমন মানষির উপজন হয় যার নাম শুনিলে যেমন শ্রদ্ধা আর ভক্তিতে মাথাটা আপেনে হেট হয়া আইসে; তেমনে একেসোদে বুকত শক্তি আর সাহস যুগি দেয় উমরা। আর এই মানষিলা যে বড় মানষি হয়া ওঠে তাও কোনো একেনা-দুখুনা কাজের বাদে না হয়; ঝতদিন বাচে উমরা সমাজের মানষিগুলার বাদে বা স্বজাতির ভালের বাদে একেনা-সেখেনা কাজ করিয়ায় থাকে। এই মানষিগুলার গোটায় জীবনের কর্মকাণ্ড দেখি মনে হয়, উমরা জীবনটা যেনে এই সমাজ বা জাতিটার বাদেয় গতে দিচে। উমার নিজের বুলি কিছুই নাই। নিজের ঘর-সংসার-ছাওয়া-বউ-সুখ-শান্তি কিছুই উমার কামনা না হয়। উমার লইক্ষ্য আরো বড়। কিন্তুক তা হইলেও ঝত কাজ করি যায় তার সউগগুলা না হয়, কোনো একেনা বা দুখুনা কাজ উমার জীবনের সবচাইয়া বড় কাজ হয়া ওঠে। ওই একেনা দুখুনা কাজের বাদেয় আমরা উমাক বেশি করি ফম রাখি। এক একঝন এইনাকান বড় মাপের মানষির নাম শুনামাত্র ওই একটা দুইটা কাজের কথায় আগোত মনত আইসে। যেমন রামমোহন রায়ের নাম শুনিলে পখমেয় ‘সতীদাহ প্রথা' বন্ধ করার বাদে উমার গোটায়জীবনের সংগ্রামের কথা ফম পড়ে, দেশের মানষির ভিতিরা নয়াজাগরণ আনি দিবার কথা ফম পড়ে; যেমন বিদ্যাসাগরের নাম শুনিলে ‘বাল্যবিবাহ’ আর ‘বহুবিবাহ’ বন্ধ করা আর বিধুয়াবিয়াও চালু করার বাদে উমার অবদানের কথা কম পড়ে বা ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার কথা আসিলে ফম পড়ে ২৭শা মাঘের কথা—যেদিন উমরা রাজবংশী ক্ষত্রিয় জাতিক পতিত অবস্থা হাতে উদ্ধার করির বাদে দেবীগঞ্জের করতোয়া নদীর পারোত হাজার হাজার রাজবংশী যুবকের গালাত পৈতা তুলি দিয়া আত্মশক্তি বাড়েবার ঐতিহাসিক কাজটা করি ফেলাইল। আর হাজারটা কাজ না করিলেও যেনে উমার কোনো আসিলেক গেইলেক না হয়, এই একেনা-দুখুনা কাজ করি মরি গেইলেও মানষি ফম থুইলেক হয় এইলা মানষিক। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, রাজবংশী জাতির গৈরবের ধন, বুকের ধন কলীন্দ্রনাথ বর্মণের নামটাও এই ঢক করিয়ে আমরা ফম করি।

কলীন্দ্রনাথ বর্মণ পথম রাজবংশী ভাষার অভিধান লেখাইয়া। এইটায় উমার জীবনের সবচাইয়া বড় আর মহৎ কাজ বুলিয়া আমরা সগায় মানি নিছি। আজি হাতে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের উত্তরবঙ্গত এত ঘাটাপথ না আছিল, না আছিল এটেওঠে পচ করি আইসা যাওয়া করির ভাল কোনো গাড়ি-ঘোড়া। কাচা রাস্তাত ভের-কাদো, জঙোলের রাস্তাত বাঘভাল্লুক তারে মইধ্য দিয়া মানষির চলাফিরা, যাওয়া আইসা। সেই সমায় নানান সামাজিক কাজকর্মত নেতৃত্ব দিবার ফাকে ফাকে উত্তরবঙ্গর গ্রামে গ্রামে ঘুরি ঘুরি চাইর বছর ধরি যেগুলা রাজবংশী শব্দ জোগাড় করির পাইচে তাকে দিয়া জলপইগুড়ির উত্তরবঙ্গ প্রেস হাতে ছাপে শিলিগুড়ির পঞ্চানন আশ্রম হাতে বির করিচে ‘রাজবংশী অভিধান'। সেলাও ছাপা শেষ হয় নাই, ১৭ জানুয়ারি ১৯৭১ সালে কলিকাতার যুগান্তর পত্রিকা নেখিচে– ‘উত্তর-বঙ্গের রাজবংশী সম্প্রদায়ের অন্যতম বিশিষ্ট নেতা ও সমাজ সংস্কারক শ্রীকলীন্দ্রনাথ বর্ম্মণ রাজবংশী ভাষার যে অভিধান রচনা করেছেন তা স্থানীয় একটি প্রেসে সযত্নে ছাপা হচ্ছে। একান্ন বৎসর বয়স্ক কলীন্দ্রনাথ বর্ম্মণ দীর্ঘ চার বৎসর কাল উত্তর বঙ্গের গ্রামে গ্রামে ঘুরে অভিধানের শব্দসমূহ চয়ন করেছেন। এই অভিধানে আছে বর্ণানুক্রমিক রাজবংশী ভাষার শব্দাবলী, ছিল্কা বা উত্তর-বঙ্গের প্রবচনসমূহ, ভাষা- বিচার, বহিরাগত শব্দের তালিকা ইত্যাদি। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘জয় মানব মানবতার জয়’ নামে কলীন্দ্রনাথ বর্মণের এখান চটি কবিতার বই বির হয়। বইখানের ভিতিরা রাজবংশী অভিধানের এখান বিজ্ঞাপন ছাপা আছিল। ঐঠেকার খানিক অংশ তুলি দিলে অভিধানখান বিষয়ে আরো খানিক জানা যাবে। বিজ্ঞাপনত লেখা হইচে— উপেক্ষিত ও অনাদৃত অথচ অমূল্য সম্পদ রাজবংশী ভাষার একখানি অভিধান প্রকাশিত হইয়াছে। ইহাতে পাঁচ হাজার শব্দ, চারশত প্রবচন বাক্য, উত্তর-বাংলার ভৌগোলিক ও বিবিধ জ্ঞাতব্য বিষয়ের উল্লেখ আছে। প্রথম প্রচেষ্টা হেতু সংক্ষিপ্ত হইলেও গ্রন্থখানি অপূর্ব হইয়াছে। সাহিত্যপিপাসু ব্যক্তিমাত্রেই এই অপূর্ব গ্রন্থখানি একবার পড়িয়া দেখা একান্ত উচিত।’ ড. গিরিজাশংকর রায় রাজবংশী কবিতাসংকলন ‘সাতভাইয়া’র ভূমিকাত কলীন্দ্রনাথ বর্মণের প্রতিভার কথা সংক্ষেপে লেখিচে। এই অভিধানখানের কথা তুলিয়া উমার মত এইনাকান— তবে কলীন্দ্রনাথ বর্মণ যে অক্ষয় কীর্তির জন্য আমাদের সকলের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তা হল তাঁর “রাজবংশী অভিধান”। তিনি যদি বাঙলা বা রাজবংশী ভাষায় আর একটি পংক্তিও না লিখতেন তাহলেও বিশেষ কিছু এসে যেত না। তাঁর সংকলিত এই অভিধানটির জন্যই বাঙলা তথা রাজবংশী ভাষা তাঁর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।

কলীন্দ্রনাথের জন্ম এলকার বাংলাদেশের ভিতিরা বোদা জেলার দেবীগঞ্জ হাতে চাইর মাইল উত্তর দিয়া করতোয়া নদীর পশ্চিমপাখে টাকাহারা নামে একটা গ্রামত। তারিখ ১৯২৯ সালের ২রা ডিসেম্বর। ঐঠেকার বুনিয়াদি প্রধান বংশটা আছিল নামিক্কর বংশ। ঐ বংশের প্রসন্নকুমার বর্মণ প্রধান উমার বাপ আর মাও হইলেক সাহেবানী দেবী। প্রসন্নকুমার আছিলেক খিব সাদাসিদা মানষি। দান-খয়রাতি করিবার বাদে হাত আছিলেক খোলা। এইজন্যে ঐ গেরামের সউগ মানষি উমার নাম দিচে হলকা প্রধান। হলকা প্রধান আর সাহেবানী দেবীর সাত বেটাবেটির ভিতিরা কলীন্দ্রনাথ আছিল সগারে ছোট। ছোট বুলিয়া গেরামের মানষি উমাকও ডেকাইচে ছোটভাই বুলিয়া। পথমে টাকাহারা পেরাইমারী স্কুলত ভত্তি হয়া দুই বছরের ভিতিরা পড়াশুনা শেষ করি যায়া ভত্তি হয় সাকোয়া মইধ্য ইংরাজী স্কুলত। ১৯৩৮সালে জলপইগুড়ি জেলা স্কুল কেন্দ্ৰত যে ‘মিড্‌ড্ল স্কলারশিপ’ পরীক্ষা হয় কলীন্দ্রনাথ বৃত্তি পাবার বাদে ঐ পরীক্ষাত বইসে। ফল বিরাইলে দেখা যায় জলপইগুড়ি জেলার মইধ্যে উমরায় হয় পথম। কিন্তুক মিডল স্কলারশিপ পাইলে হবে কি, সংসারোত এই সমায় কতকগুলা ঘটনা-অঘটনা ঘটিবার ধরে। বাপ-মাও বাচি থাকিতে একঝন বড় ভাই ধরণীধর বর্মণ বাড়ি ছাড়িয়া সৈন্নাসী হয়া যায়। তারপাছোত একে একে বাপ, মাও আর চাইর-চাইরঝন দাদা অকালতে মরি যায়। এইনাকান সমায়ে বড় ক্লোসত পড়িয়া শিক্ষিত হবার আশা উমাক একেবারে ছাড়িয়ায় দেওয়া খায়। কিন্তুক ঝার বুকত শিক্ষিত হয়া সমাজের সউগ মানষির সউগনাকান মঙ্গলের কাজত— বিশেষ করিয়া ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার আদর্শত অনুপ্রাণিত হয়া রাজবংশী ক্ষত্রি জাতির ক্ষাত্র আন্দোলনত ঝাপ্পে পড়িবার সংকল্প তাক আটকাবে কায়? পড়াশুনা বন্ধ করি কলীন্দ্রনাথ সাধুর ভেশ ধরিয়া দেশের নানান জাগাত কিছুদিন ঘুরি বেড়েবার ধল্লেক। শেষ পর্যান্ত পুলিশ যায়া জোর করি ধরিয়া বাড়ি আনিল। তাত জীবনত খানিক থিতি আসিল। বোদার দেবীগঞ্জ থাকি যেলা উমরা পাকাপাকি এই দেশত চলি আইসে সেলা সহজে এটেখুনা কোনো কাজ জোটে নাই। কিন্তুক বাচি থাকিবার বাদে তো একটা কাজ দরকার! কী করা যায়? শেষমেশ নকশালবাড়ির পানিটেস্কি হয়া নেপালের মোরং যায়া কিছুদিন থাকে। ঝাপা, মোরং, ভদ্রপুর নেপালের ঐ অঞ্চলগুলাত রাজবংশী মানষির বসতি এলাও ঘিসঘিসা। আজিও উত্তরবঙ্গর রাজবংশী মানষিলার কাঙো ওঠেখুনা গেইলে ওখান মনে হয়না, নিজের জাগা বুলিয়ায় মনে হয়। মোরং-ওত যায়া কলীন্দ্রনাথ কিছুদিন ছোটছোট ছাত্রছাত্রীগুলা পড়েয়া খাওয়াপড়ার খরচ জোটেবারচেষ্টা করে। পরে ওঠে থাকি আসি থায়ী হয় শিলিগুড়ির ডাবগেরামত। ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা (১৮৬৬-১৯৩৫) রাজবংশী ক্ষত্রি জাতিক জাগে তুলিবার বাদে সমাজোত একটা ধাউসানি আন্দোলন তুলি দিয়া মাত্র কয়বছর আগোত স্বর্গ চলি গেইচে। অইন্য অনেকের নাকান কলীন্দ্রনাথের বুকত-ও সেই আদর্শ । ঠাকুর পঞ্চাননের আদর্শ সগারে ঘরে ঘরে পংছে দিবার বাদে উমরা ডাবগেরাম আসি পঞ্চানন আশ্রম তৈয়ার করিলেক। ঠাকুর পঞ্চাননের আদুরা কাজগুলা পুরা করিবার বাদে, ক্ষত্রিজাতির ভিত শক্ত করি তৈয়ার করিবার বাদে এই নিন্দত পড়ি থাকা জাতিটাক ডেকে ডেকে তুলির ধরিল। 'আপন পায়ে দাঁড়াও' কবিতাত উমরা জাগরণের ডেক দিল এংকরি—

‘নিন্দিয়া থাকা পাছোৎপড়া ক্ষত্রি জাতির জাগরণ আনিয়া দিয়া গেইছিল ক্ষত্রিয়ের ঠাকুর পঞ্চানন।
ভাইরে যদি থাকে মনৎ
থাউক না কেনে দেশের কোণৎ,
আবার তার আদর্শে তমরাগেলা দেও মন।
ভাইরে না করেন পরার আশ সংঘ-সমিতি গড়াও,
নীচৎ পড়িয়া রহা জাতি আপন পায়ে দাঁড়াও।
যাই যদি পরবাস
তাও না করি পরার আশ,
জাগো, এই হিয়াচার দিন যদি বাঁচিবার চাও!'

দিন নাই নাত্তি নাই খাওয়া নাই দাওয়া নাই খালি একটায় চিন্তা, ক্যাং করি জাতিটার হিত করা যায়, ক্যাং করি জাতিটাক খানিক আগে নিয়া যাওয়া যায়। সমাজ জাগরণের এই কাজত নিজক একেবারে উৎসর্গ করি দিল। এই প্রসঙ্গত অবনী প্রসাদ সিংহর দুইটা কতা তুলি ধরা যায়। বাংলা ১৩৭৬ সালের ডোল পূর্ণিমার দিন বির হওয়া কলীন্দ্রনাথ বর্মণের ‘নয়া ডেগর’ বইয়ের প্রকাশক শ্রীঅবনী প্রসাদ সিংহ প্রকাশকের নিবেদন অংশর সূচনাতে লেখিচে– ‘উত্তরবাংলার অবহেলিত, লাঞ্ছিত, ভাগ্যাহত সমাজ জাগরণের জন্য শ্রীকলীন্দ্রনাথ বর্ম্মণ একান্তভাবে নিজেকে উৎসর্গ করিয়াছেন। তিনি সারাজীবন হাট-ঘাটে, মাঠে-পথে আকুল কণ্ঠে চিৎকার করিয়া বেড়াইতেছেন, জাগো, জাগো সর্বহারা।’ গাত ভাল কাপড় নাই, ঠ্যাঙোত নাই একজোড়া জুতা, খালি মনোবলের উপুরা ভরসা করিয়া আর মানষির উপুরা বিশ্বাস করিয়া উমরা বক্তৃতা দিয়া বেড়েবার ধরিল। সুবক্তা কলীন্দ্রনাথের বক্তৃতা শুনির বাদে মানষি ভিড় করি আইসে। ছোটবেলা হাতের লেখাপড়াত ভাল ছাওয়াটা হেটেহোটে ঘুরি বেড়েয়া থাকে বুলিয়া কাঙো কাঙো উমার মা-ক যায়া কতা শুনাইলে তার উত্তর সাহেবানী দেবী যেমন করি দিচে তার তুলুনা চান্দে পাওয়া কঠিন! কইচে– সাত বেটার মাও মুঞ; মোর সাত বেটা। একটা বেটাক ধরম ঠাকুরের নামে ছাড়িয়া দিছু। সে বোলে দেশের উপগার করিবে। দেশের উপগার করিতে মোর একটা বেটা কোনঠে যায়া মরে মরোক।' মনত কত জোর থাকিলে একঝন মাও এইনাকান কথা কবার পায়, সেটা ভাবিলে ঠাস খাবার নাগে! এইঢক মাও না থাকিলে কি আর কলীন্দ্রনাথ কলীন্দ্রনাথ হবার পাইলেক হয়? যাই হউক, মাওয়ের এই আদেশ মাথাত নিয়ায় উমরা সারা জীবন দেশের কাজ করিয়া গেইচে! উমরা ক্যাং করি সভাসমিতি করি ঘুরি ঘুরি জাতিক সংঘবদ্ধ করির বাদে জীবনক পণ করিচে, সমাজত ঘটি যাওয়া অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ করির যায়া বারে বারে বিপদত পড়িচে, নারী জাতির অপমানের শোধ তুলির বাদে লড়াই করিচে, হিন্দু মুসলমানের সম্পর্কক ভাল রাখির বাদে সাম্প্রদায়িক ভাবনার উপুরাত উঠিয়া কাজ করিচে —সেখেনা এখান বড় ইতিহাস! সেই ভুলি যাওয়ার দশাত পড়া ইতিহাসখান তুলি ধরিবার সমায় পার হয়া যাবার ধরিচে। এলায় ওখান আলদা জাগাত ভাল করিয়া নেখি ফেলা দরকার। অইন্য নেখাত আর একসমায় সেই চেষ্টা করা যাবে। এঠেখুনা অল্প করি কলীন্দ্রনাথ বর্মণের কিছু লেখালেখির পরিচয় তুলি ধরির চেষ্টা করা হইল।

মাঠেঘাটে আন্দোলন করি সমাজক জাগেবার চেষ্টা করির গেইলে শিল্পী সাহিত্যিকের লেখনী বা আঁকনি খানিক খানিক বাধা পাবার পায়। কলীন্দ্রনাথ বর্মণের ক্ষেত্ৰত যে সেটা হয় নাই তা না হয়। কিন্তুক মাত্র ৫২ বছরের পরমায়ু ধরি আসি উমরা সাহিত্য ক্ষেত্ৰতও যে অবদান থুইয়া গেইছে সেটা রাজবংশী ভাষা আর সাহিত্য যদ্দিন টিকি থাকিবে তদ্দিন ভটভটা হয়া রবে। ছোট ছোট কয়খান কবিতার বই আর নানান পত্রপত্রিকাত ছড়ি ছিটি আছে তার প্রতিভার চিন। এই প্রসঙ্গত অবনীপ্রসাদ সিংহ আরো লেখিচে— তিনি সমাজ সেবার তাগিদে আর্থিক দিক দিয়া অতি দীন কাঙ্গাল বটে কিন্তু তিনি একজন বিরাট বিদ্বান ব্যক্তি। তাহার বহুমুখী প্রতিভা বিদ্যমান। তিনি বাংলা হিন্দী, নেপালী, উর্দু, ইংরাজী ও রাজবংশী এই কয়েকটি ভাষা লেখিতে, পড়িতে ও বলিতে পারেন। তাহার কবিত্ব শক্তিও প্রশংসার দাবী রাখে। তাহার ভাষাও সুন্দর এবং হস্তাক্ষরগুলিও অতি চমৎকার... তাহার লেখা বহু শারদীয় সংখ্যা ও সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছে।” এদি অভিধানের বাদে শব্দ জোগাড় করা, নানান জাগাত ঘুরি বেড়েয়া লোকসাহিত্য প্রবাদ প্রবচন ছিল্কা জোগাড় করা, ইতিহাস আর সংস্কৃতির নানান তথ্য জোগাড় করি বইয়োত নিকিলা—একেসোদে সউগ হবার ধরে। কবিতা লেখি ছাপেয়া বির করা তো আছেয়।

লেখালেখির সমায় কলীন্দ্রনাথ একটা ছদ্মনাম ব্যবহার করা খুব পছন্দ করিচে, সেটা হইল ঢবাডাঙ্গা বর্মণ আর নামের আগোত সউগ সমায় ‘কৃষক কবি’ কতাটা লেখির ভাল পাইচে। কৃষক কবি কলীন্দ্রনাথের কবিতার বইগুলা হইলেক— আংসাং, আউচালি বাউচালি (১৩৬৮), নয়া ডেগর (১৩৭৬), জয় মানব (১৯৭১)। আরও কোনো কোনো কবিতার বই কোনোঠেখুনা পাওয়া যাবার পারে। কিন্তুক উমার কোনো বইয়ে আর খুব সহজে পাবার উপায় নাই! ড. গিরিজাশংকর রায়ের সম্পাদনাত বাংলা ১৩৬৮ সালে রাজবংশী কবিতাসংকলন ‘সাতভাইয়া’ পথম বির হয়। এখান বইয়ের ভিতিরা কলীন্দ্রনাথের ১৯খান কবিতা ঠাই পাইচে।

সারাদিনমান সমাজের কাজত ঘুরি বেড়েয়া নাত্তি হইলে যার খানিক জিরিবার দরকার উমরা কোন সমায় লেখে কবিতা, কোন সমায় তৈয়ার করে অভিধানের কাজ?
কলীন্দ্রনাথ লেখিচে—

‘গ্রামে গ্রামে ঘুরি আমি
মোর জিরিবার নাই অবসর,
রাত বারোটায় লেখিনু
কবিতা বসিয়া শয়ন ঘর।'

অবসর না থাকিলে কি আর কবিতা লেখা থামি রবে? বিশেষ করি যার ভিতিরা যেমন করি হউক সমাজের হিত করিবার বাদে উত্থালপাথাল ঢেউ ঝাপটাঝাপটি করে, তার কি নিশ্চিন্তে জিরাইলে চলে। এইজন্যে ইমার সউগ কবিতা লেখিবার পাছিলাত চান্দে পাওয়া যায় সমাজের ভাল ক্যাং করি করা যাবে তারে চিন্তাক। কবিতা ক্যাং করি সুন্দর হবে তার থাকি বড় বিষয় হইল কবিতাক ক্যাং করি সমাজের কাজত নাগা যাবে— কবির আছিল এইটায় চিন্তা। ‘আউচালি বাউচালি’ আর ‘জয়মানব’-এর কবিতাগুলাত ভলভলা হয়া আছে কবির রাজনৈতিক চিন্তা। কোনপথত গেইলে মানষির ভাল হবে সেই বিষয়ে উমার পষ্ট কথাটা পষ্ট করিয়া লেখিচে। সেইসোদে কাব্যর তির্যক ভঙ্গি আসিও কোনো-কোনোঠে খুব চমৎকার করি কবিতার স্বাদ বাড়ে দিচে! মানষির ভোট নিয়া নেতাগিরি করা মানষিলা কোনোদিনও মানষির ভাল করির না চায়। সেই সমায়ে কি আর এই সমায়ে কি! ‘ভরষা দিয়া পথত বসালো’ কবিতাত কলীন্দ্রনাথ লেখিচে—

‘মনে বড় দুখ নেতারে
মোর চিতে বড় দুখ
ডাডই নদীর ধাদিনার মত
ভাংগিয়া পড়ে বুক।
কত না দুঃখ কইম
দুঃখের নাই মোর ওর
সব্বাতে অধিক দুঃখ
দেখা না পাও তোর।

রোমান্টিকতাও উমার কোনো কোনো কবিতাক অসাধারণ করি তুলিচে। মাটি, মানষি আর মানষির সংস্কৃতির বাদে হিয়ার টানের সোদে এই রোমান্টিকতা জড়েনাপ্টে আছে। 'হামার উত্তরবাংলা' কবিতার দুই-একটা লাইন এঠেখুনা তুলি দিলে খানিক বোঝা যাবার পারে

‘কোন দেশৎ মাতিয়া উঠায়
ভাওয়াইয়া সুরের গান?
কোন দেশৎ রাজবংশী ভাষায়
আকুল করে প্রাণ?
কোন দেশৎ ঘরের চেঙ্গেরিক্
বাহির করে দোতারা রে?
সে হামার উত্তরবাংলা
হামারে উত্তরবাংলা রে।”

মাওয়ের ভাষার উপুরা এমন দরদের পরিচয়, নিজের সংস্কৃতির উপুরা এমন ময়া-মমতা ভালোবাসার পরিচয় কয়ঝন কবির লেখাত পাওয়া যাবে? ওই সমায় রাজবংশী ভাষার কবিতাত উপমা ব্যবহার করার ক্ষেত্রতও বা উমার নাকান আর কয়ঝনক পাওয়া যাবে? যেমন একটা কবিতাত পাই—

ভূঁইয়ের চিকন আলি
ভেমরুলের চিকন বাসা
মানষির চিকন শালি
জাতির চিকন ভাষা।।

পণ্ডিত ম্যাক্সমুলারের মতে, যে জাতি উমার নিজের ইতিহাস না জানে ঐ জাতির উন্নতির কোনোয় আশা নাই! এই কথাটায় কলীন্দ্রনাথ বর্মণ ফম করি দিয়া ঐ ‘জাতির চিকন ভাষা’ কবিতাত লেখিচে—

‘মরি কি চমৎকার
হামার রাজবংশী ভাষা
রাজবংশী ভাষার সনে
তমরা কর ভালোবাসা।

সমাজের উপুরা দায়বদ্ধ কবি সমাজের মানষির বাদে বিশেষ বিশেষ বক্তব্য উমার কবিতা দিয়া কবার চাইচে। ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার আদর্শ আছিল উমার জীবন ভরি। 'আপন পায়ে দাঁড়াও' কবিতাত পাই পঞ্চানন বর্মার কথা—

‘নিন্দিয়া থাকা পাছোৎ পড়া ক্ষত্রি জাতির জাগরণ
আনিয়া দিয়া গেইছিলো ক্ষত্রিয়ের ঠাকুর পঞ্চানন।
ভাইরে যদি থাকে মনৎ
থাউক না কেনে দেশের কোণৎ,
আবার তার আদর্শে তমরাগেলা দেও মন।'

ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা কইচে, ভিক্ষা করিয়া হইলেও লেখাপড়া শেখান। কইচে— বিদ্যাহীন ব্যক্তি পশুর সমান... সৎ শিক্ষার গুণে লোক দেবত্ব প্রাপ্ত হইয়া থাকে।... যে জাতির মধ্যে বিদ্বানের সংখ্যা অধিক, সেই জাতিই সুসভ্য জাতি বলিয়া জনসমাজে পূজ্য ও সমাদৃত।'কবি কলীন্দ্ৰনাথও ‘ধেত্তোর আংসাং’ কবিতাত লেখিলেক—

‘ধেত্তোর আংসাং নোকক্ কি কর মুই
ছাওয়াটাক কিতায় স্কুলত না পাঠাইস তুই?
ভাইরে এই দিনত বাঁচিয়া থাকিবার যদি চাও
সংগত করিয়া ছাওয়াগেলাক লেখাপড়া শেখাও।'

ছাওয়ার বাপ-মাওয়ের ঘরক যেমন কবিতা দিয়া এইঢক করি কইল, তেমনে ‘ডিংগাউ ডিংগাউ’ কবিতাত ছাত্রগিলাকও কইল—

‘লেখাপড়া কর তম্যরাগেলা খুব মন দিয়া,
আংসাং না করেন তম্যা শক্ত করি বান্দ হিয়া...
সময় চলিয়া যায় তিস্তা নদীর স্রোতের মত,
তম্যরাগেলাক বহু কহিনু, আর কহিম্ কত?’

উত্তরবঙ্গর ভূপ্রকৃতি আর আর্থ সামাজিক অবস্থার ছবিও কবির মেলা কবিতাত ধরা পড়িচে। ধরা পড়িচে রাজবংশী জীবনের অতীত ইতিহাসের ছবির বগলবগলি পত্তিদিনকার ছবিও। যে কবি নিজক পরিচয় দিচে ‘কৃষক কবি’ বুলিয়া তার কবিতাত কৃষকের সুখদুঃখের ছবি তো থাকিবেয়। এইঠেকার ভূমিপুত্র যায়, এই জাগাতে যার জনম, চৈদ্দপুরুষ হাতে এইঠেখুনায় যার বাস তাও উমার পাতত কেনে দই, ঘিউ পড়ে না— এই আক্ষেপ কবির কবিতাত গোপন থাকে নাই। লেখাপড়া শিখিয়া ছাওয়াছোটগুলা বড় হবে, বড় বড় চাকরি করিবে, তাঙো যেনে কৃষকের সোদে উমার সম্পর্ক ছিড়ি না দেয়—এখিনা কবির ইচ্ছা। কারণ ইমরা তা কৃষকের ঘরেরে ছাওয়াপোওয়া! থাকিস না আর ঘরে কবিতাত কবি লেখিচে—

‘কাহো হমো এস. ডি. ও. কাহো হমো বি.ডি.ও.
জানিমো কৃষকের মনের কথা
মিশিয়া চাষীর সাথে কাজ করি হাতে হাতে
দূর করিমো অন্তরের ব্যথা।
হামা যত কিছু হই চাষী সাথে যেন রই
চাষীদের করিমো না অবহেলা,
হামা চাষীর সন্তান রাখিতে দেশের প্রাণ
রত থাকি জীবনের সারাবেলা।'

এইঢক করি দেখা যায় কলীন্দ্রনাথের বেশিরভাগ কবিতাত সউগ সমায় সমাজের বাদে, অবহেলাত পড়ি থাকা মানষির বাদে, একটা বিশেষ বক্তব্যয় বড় হয়া ওঠে। যার গোড়ের কথা হইল মূল্যবোধ, সৎ উদ্দেশ্য আর আদর্শ। ড. গিরিজাশংকর রায়ের ভাষাত কবার গেইলে কওয়া খায়—— তিনি কলম ধরতেন সমাজের হিতের জন্য... কলীন্দ্রনাথের সাহিত্যসৃষ্টির মধ্যে লুকিয়ে ছিল সমাজহিতৈষণার বিষয়।’ এক আদর্শবাদী সমাজ সংস্কারক, মানবতাবাদী আর রোমান্টিক কবিচৈতন্যর মালিক আছিল কলীন্দ্রনাথ। জীবন হাতে যেলা বিদায় নেওয়ার সমায় হয় নাই, ১৯৮১ সালের ২রা অক্টোবর মাত্র ৫২ বছর বয়সত উমরা ইহজীবনের সউগ মায়া কাটেয়া চলি যায়। এই মহান মানষিটাক হারেবার দুঃখ আর একঝন মহান কবি শ্যামাপদ বর্মণের লেখা গানত ডুকুরি ডুকুরি কান্দি ওঠে—

“ও হামার ধন
কলীন বর্মণ রে
কুণ্ঠে গেইলেন আজি কত দূরে
তোমার বাদে আমার মন ঝুরে রে
কান্দে তোমার শোকে
দেশের ক্ষাত্র গণরে।'

খেও:
১) কলীন্দ্রনাথ বর্ম্মণ: ভোটের আউচালি বাউচালি ১৩৬৮ প্রকাশক, হেরম্বকুমার দেব, জলপাইগুড়ি

২) কলীন্দ্রনাথ বর্ম্মণ: নয়া ডেগর, ১৯৬৯ পঞ্চানন আশ্রম, শিলিগুড়ি

৩) কলীন্দ্রনাথ বর্ম্মণ: রাজবংশী অভিধান, ১৩৭৭ পঞ্চানন আশ্রম, শিলিগুড়ি

৪) কলীন্দ্রনাথ বর্ম্মণ: জয় মানব, ১৯৭১ পঞ্চানন আশ্রম, শিলিগুড়ি

৫) ড. গিরিজাশংকর রায় (সং) : সাতভাইয়া, ২০০৩ উত্তরবঙ্গ প্রকাশনী, শিবমন্দির, শিলিগুড়ি

(৬) কবিরত্ন শ্যামাপদ বর্মণ: ক্ষাত্রসংগীত, প্রকাশক রথীন্দ্রনাথ রায়, ননীগোপাল রায় জলপাইগুড়ি, ১৪০৩

ধার:
নগেন্দ্রনাথ রায়, শিক্ষারত্ন শিবমন্দির, শিলিগুড়ি
_________________
খুঁজি নেওয়া— ভোগা (পহিলা সংখ্যা, কাতি ১৪২১) সম্পাদক: নিখিলেশ রায়। প্রকাশ: রাজবংশী ভাষা আকাদেমি।

Post a Comment

Previous Post Next Post