ছ্যাওয়ে ছ্যাওয়ে রাজবংশীলার কথা —ড. দ্বিজেন্দ্রনাথ ভকত

ছ্যাওয়ে ছ্যাওয়ে রাজবংশীলার কথা
ড. দ্বিজেন্দ্রনাথ ভকত

ইতিহাসঃ উন্নিশ আর বিশ শতকের শেষ দশক পর্যান্ত যেগুলান নৃতাত্ত্বিক পণ্ডিত, ঔপনিবেশিক আমলের ইংরাজ সিভিলিয়ান, ডাক্তার, ঐতিহাসিক আর নৃবিজ্ঞানী রাজবংশীলার বিষয়ে গবেষণা আর মতামত দেয় উমার বেশিরভাগে একমত হৈছে যে, কোচগুলায়েই পরে কোনসমায় রাজবংশী বুলিয়া পরিচয় দিবার ধরে। একটা সমায় অর্থাৎ উন্নিশ শতকের শেষ আর বিশ শতকের পথম ভাগত উমরা উত্তরবঙ্গ আর পশ্চিম অসমত পঞ্চানন বর্মার নেতৃত্বত ক্ষত্রিয় হিসাবে দাবী করার আন্দোলন করে। উত্তরবঙ্গ, বিহার, নেপাল ইত্যাদি জাগার রাজবংশীগুলানে এলা ক্ষত্রিয় বুলিয়া দাবী কইল্লেও অসমত এলা এই দাবী মৈলাম পড়িছে। কারণ অসমত জনজাতি (Sehcdule Tribe) হিসাবে দাবী জোরদার হৈছে। নয়া প্রজন্মর এই জাতিটার বিষয়ে নয়া করিয়া পড়াশুনা আরাম্ভ করাত ক্ষত্রিয়ের দাবীটা পেরায় জাগাতে মৈলাম পড়িচে দেখা যায়। পূর্বোক্ত গবেষক-পণ্ডিতগুলায়ের গবেষণা থাকিয়া একটা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে আইসে যে কোচগুলায় কোন্‌সমায় ক্যাং করিয়া আর কোন্ প্রেক্ষাপটত রাজবংশী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করিছে? ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, বৃহৎ ধর্মপুরাণ পঞ্চদশ শতকত নেখা দেবীবর মিশ্রের খেলবিধি, ধ্রুবানন্দ মিশ্রের কুলকারিকা ইত্যাদি বইগুলাত কোচ জাতির কথা পাওয়া যায়। যোগিনীতন্ত্র আর পদ্মপুরাণ সপ্তদশ শতকের তারিখ-এ-আসাম, আলমগীরনামা, অষ্টাদশ শতকের রিয়াজম সালাতন, উন্নিশ শতকের খোর্শেদ জাহানামা আদি মুসলমান ঐতিহাসিকগুলার বইওত কোচ আর মেচ জাতির কথা পাওয়া যায়।

মধ্যযুগত নেখা কাব্যগুলাতো কোচের কথা পাওয়া যায়। বর্তমানে উত্তরবঙ্গ অঞ্চলের কোনো কোনো জাগাত কোচ রাজবংশী, কোচ-পলিয়া, পলিয়া-রাজবংশী আদির কথা শুনা যায়। অইন্যপাকে অসমত কোচ রাজবংশীর কথা পাই। বেদ, পুরাণ, মনুসংহিতা আর উপুরার বইগুলার কোনো জাগাতে জাতি হিসাবে রাজবংশীগুলার কথা পাওয়া না যায়। সগারে পথম ড. বুকানন হ্যামিলটন (১৮০৭-১৮০৯ খৃঃ ৩) কোচগুলার সাথত একঠে করিয়া রাজবংশীলার কথা উল্লেখ করে। সেইজন্যে আমরা সহজে অনুমান করিবার পাই যে, সেইগুলান গ্রন্থ নেখার সমায় ‘রাজবংশী' নামে কোনো জাতি আত্মপ্রকাশ করে নাই। ভারতবর্ষত কোচ জাতির পথম বসতি অঞ্চল হইল পশ্চিম অসম আর উত্তরবঙ্গ অঞ্চল। এই বিষয়ে অসম সম্পর্কে সেইটের আদম সুমারী রিপোর্ট আর. এইচ. এস. হাসিনসনের ইষ্টার্ণ বেঙ্গল এন্ড আসাম ডিষ্ট্রিক গেজেটিয়ের আর ই. টি. ডাল্টনের জাতিতত্ত্বের গ্রন্থত সমর্থন পাওয়া যায় যে, ষোল্ল শতকের দুতিয়া ভাগত কোচ জাতির রাজা হাজোের ভাগীগুষ্টিগুলায়ে রাজার বংশধর হিসাবে কোচ নাম ছাড়িয়া রাজবংশী নাম নেয়। কোচ আর পলিয়াগুলানে পরবর্তী সমায় রাজবংশোদ্ভব ‘রাজবংশী' নাম নিয়া নিজের পরিচয় দেয়। এটিখোনা মনে রাখার মতো কথা হইল কোচগুলার যেগুলান লোক আর্থিকভাবে খানেক সচ্ছল আছিলো উমরা রাজার অনুগামী আছিলো আর রাজার সাহচর্য লাভ করিছিল। ফলে উমরা নিজকে রাজবংশী বুলিয়া পরিচয় দিয়া কোচ থাকিয়া আলাদা হয়া যায়। সেইজন্যে পরবর্তী সমায় আর সংস্কৃতির দিক দিয়া মিল দেখা না যায়। সেইবাদে অনেক পণ্ডিতে কোচ আর রাজবংশী আলাদা জাতি বুলিয়া প্রতিষ্ঠা করে। অন্য কতোগুলান পণ্ডিত কয়, কোচগুলান উত্তরবঙ্গ আর পশ্চিম অসমত হিন্দু ধর্ম নিয়া রাজবংশী হিসাবে পরিচয় লাভ করে।

১. সংস্কৃতির কথা : সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের খেও ধরিয়া রাজবংশী সংস্কৃতির কথা আলোচনা করিলে আমরা কতগুলান কথা উপলব্ধি করিবার পাই। তারে হাইলত ফেলেয়া মোর আলোচনা সংক্ষেপ করা হইল। রাজবংশীলার উৎপত্তির বিষয়ে নৃবিজ্ঞানী আর ঐতিহাসিক পণ্ডিতগুলান কয় যে, রাজবংশীলা দেহার দিক দিয়া মঙ্গোলীয়ান নরগোষ্ঠীর। কিন্তুক উমার সাথোত প্রোটো অষ্ট্রলয়েড গোষ্ঠীর রক্ত মিশল হৈছে। ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিতগুলান কয় ইমরা আগতে বড়োভাষী লোক আছিলো। ইমাক কোচ বুলিয়া কওয়া হৈছিল। পরে ইমরা হিন্দু ধর্ম নিয়া রাজবংশী হয়, যদিও ভারতবর্ষর আর্যগুলার সৃষ্টি করা জাতপাতের সমাজব্যবস্থা থাকিয়া একেরে দোসরা। আর্য ক্ষত্রিয় হিন্দু সংস্কৃতি থাকিও দোসরা। ইমার একটা নিজের সংস্কৃতি আছে। গৈরব করার মতো ইতিহাস আছে, নিজস্বতা আছে, হাজার বছরের পুরানা একটা সংস্কৃতি আছে। ইমরা হিন্দুধর্ম নিলেও পুরামাত্রায় হিন্দু হয়। নাই। নিজের সমাজ সংস্কৃতির আচার-নীতি, সংস্কার, পূজাপার্বণ, ধর্মের কতোগুলান বিশ্বাস ছাড়িবার পায় নাই।

বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত, ঐতিহাসিক, নৃবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীগুলা রাজবংশী সংস্কৃতির অনেক উপাদান আচার, সংস্কার, ভাষা, ধর্ম অধ্যয়ন করিয়া কতোগুলান জিনিস আবিস্কার করিছে যে, রাজবংশীগুলা মরার পরে আত্মা আছে বুলিয়া বিশ্বাস করে, মরা মানষির প্রতি শ্রদ্ধা জানায়, তন্ত্র-মন্ত্র, ইন্দ্রজাল বিশ্বাস করে। প্রকৃতিক মাও হিসাবে পূজা করে। শিবলিঙ্গ, দেবদেবীর বাহন, জীবজন্তুর পূজা, গেরাম, নদী, গছ, বন, জঙ্গল, পর্বত ইত্যাদির ভিতিরা থাকা শক্তিরও পূজা করে। মানুষের রোগ-বেয়াধি, বয়া ঘটনাগুলান অশুভশক্তি দেও-ভূত পেত্নীর দ্বারায় হয় বুলিয়া বিশ্বাস করে। নানান বাধানিষেধ, জন্ম-মিত্যু, বিয়াওর আচার, নয়া খাওয়া, পুষুনা, হোলি, বেষমা, চড়কপূজা, গাজন, মনসা, বিষহরি, মারাই, শীতলা, কালী, মাশান ইত্যাদির পূজাত জনজাতীয় বৈশিষ্ট্য আছে। দশঙগতি কাজত চাউল, কলা, কলার গছ, নারিকেল, গুয়াপান, আল্পনা ইত্যাদির ব্যবহার, লিঙ্গ পূজাত ঘটির ব্যবহার, গ্রহ শান্তির জন্যে তাবিজ কবজ ইত্যাদি আর্য ভিন্ন উপাদান রাজবংশী সংস্কৃতিত পাওয়া যায়। অইন্যপাকে বিয়ার সমায় গাত হলদি দেওয়া, পানের ব্যবহার, স্ত্রী আচারগুলাতো জনজাতীয় বৈশিষ্ট্য আছে। এইগুলা রাজবংশী সমাজের আসল বস্তু।

সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের হাইলত ফেলেয়া বিচার করিলে এইগুলা বৈশিষ্ট্যর সোদে অইন্য জনজাতীয় মানষির বৈশিষ্ট্যেরও মিল পাওয়া যাইবে। রাজবংশীগুলা প্রাক্-ঐতিহাসিক কাল থাকিয়া নানান উত্থান-পতন পার হয়য়া আজিকার সমাজ ব্যবস্থা পংছিচে। তাঙ-ও ইমার জীবিকা, সামাজিক কাঠামো, সংস্কার, ধর্মীয়বিশ্বাস, ভাষার দোসরা ঢং ইত্যাদির সোদে পুরানা দিনের মিল খুঁজিয়া পাওয়া যায়। ভালেদিন থাকি রাজবংশী লোকগুলা আর্য, অনার্য জাতির সোদে একেঠে থাকা-বইসা, খেলাধুলা, ভাবের আদান-প্রদান, দেওয়া-নেওয়া থাকিলেও নিজের নিয়াম-নীতিক ইমরা মানি চলে। ইমরা ঐতিহ্যপূর্ণ জীবিকা কিষ্যি-কাজ করিয়া বাপ ঠাকুদ্দার নীতি-নিয়াম বত্তে রাখে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পাছত অসম, বঙ্গ, বিহার, নেপাল, ত্রিপুরা, মেঘালয়, ভূটান আর বাংলাদেশের রাজবংশীগুলার কিছু ধরাছাড়া রীতি লইক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করিয়া অসম বঙ্গের ক্ষেত্রত অসমীয়া-বাংলা সংস্কৃতির ঠেলাত কিছু ছাড়াধরা নাই হয় এমন না হয়। মেলামেশা, দেওয়া-নেওয়া, একেভাষাতে কথা কওয়ার ফলত সংস্কৃতিও বদলি গেইছে বুলি মনে হয় যদিও খানেক ভাল করিয়া ধেন্দেলে না দেখিলে চট করিয়া রাজবংশী সংস্কৃতি কোনটা ধরা না যায়। ইমার সংস্কৃতির অনেকে নিজের সংস্কৃতিক বাংলা আর না হয় তায় অসমীয়া সংস্কৃতি বুলিয়া ভাবে। কাঙো কাঙো বাংলা-অসমীয়া সংস্কৃতির অংশীদার রাজবংশী সংস্কৃতি বুলিও কয়। রাজবংশী মানষিলা যে ঐতিহ্যপূর্ণ সংস্কৃতি বহন করি আসির ধরিচে তাত কোনো সন্দেহ নাই। ভালেদিন ধরি বর্ণহিন্দু সংস্কৃতির সোদে একেঠেখুনা থাকিলেও ইমার ঐতিহ্যবাহী নিজের আচার তথা স্ত্রী-সংস্কারগুলা হারেয়া যায় নাই।

ধর্মপালনের বেলা বর্ণহিন্দুগুলার পূজিত দেবদেবী, পূজা অর্চনা, ভক্তিশ্রদ্ধা করার সাথতে ইমরা নিজস্ব নিয়াম অনুযায়ী বুড়াবুড়ি, যখা, তিস্তাবুড়ি, মাশান, কাতি, বাঁশ ইত্যাদি পূজা করে। ধর্মীয় সংস্কারের ভিতিরা আমাতি, যাত্রাপূজা, চড়ক, সোনারায়, কাতিপূজা, সত্যনারায়ণ, ষাইটোল, ত্রিনাথ ইত্যাদি পূজাও করে। এমুন করি সউগদিক হাতে নৃবিজ্ঞানের খেও ধরি বিচার করিলে দেখির পাই সংস্কৃতি আর ধর্মের পাকে নিজের ধর্ম ছাড়াও বৌদ্ধ, শৈব, শাক্ত প্রভাবের সাথতে অসমের শঙ্করী, বাংলার গৌড়ীয় বৈষ্ণবের দ্বারাও প্রভাবিত হৈছে। এগুলা ধিন্দি দেখি বিচার আর বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। পদ্ধতির পাকেও নজর রাখা উচিত।

২. অর্থনীতিঃ অর্থনীতির উপুরা জীবন বাচি থাকে। অর্থনীতিয়ে সমাজ ব্যবস্থাক বদলে দেয়। একটা জাতির সংস্কৃতি আর জীবনের মান উন্নতির ক্ষেত্রত অর্থনীতির গুরুত্ব বেশি। রাজবংশীলার অর্থনীতি কৃষিকাজের উপুরাতে বত্তি আছে। কৃষি থাকি পাওয়া জিনিসলায় ইমার আসল তবিল। ব্রিটিশ যুগের পথম পাকের কোচগুলার আর্থসামাজিক অবস্থার বিষয়ে জানিবার হইলে বৃটিশ সিভিলিয়ানগুলার লেখা বিবরণ থাকিয়া জানা যায়। এইক্ষেত্রত উল্লেখ করার নাখান হইল বুকাননের বিবরণ (১৮০৯, ১৮০৭-১৪), জেনকিনসের ডায়েরি আর টীকা (১৮৩৭ আর ১৮৪৭), হজসনের প্রবন্ধ (১৮৪৭), হান্টারের স্টাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট (১৮৭০)। ১৮৭২ সন থাকি আরাম্ভ করি পরের আদমসুমারী রিপোর্ট, নানান ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার রিপোর্ট (১৮৭০, ১৮৯৮ আর ১৯৩০) ইত্যাদি। স্বাধীনতার পরের সমায়গুলাত পাওয়া যায় কতগুলান নৃতাত্ত্বিক সমীক্ষা। বিশেষ করিয়া চারুচন্দ্র সান্যালের মেচ, রাজবংশী আর টোটোগুলার বিষয়ে করা আলোচনা। এইগুলা থাকিয়া সেই সমায়কার কোচ-রাজ-বংশীগুলার আর্থসামাজিক অবস্থার বিষয়ে কিছু কথা জানা যায়।

পথমে কোচরাজবংশীগুলার ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা আর কৃষি অবস্থার স্বরূপের ক্ষেত্রত আমরা পাই তালুকের কথা। কোচ-রাজবংশীলোকগুলার বসত করা অঞ্চলও বিশেষ করিয়া অবিভক্ত ভারতের রংপুর জেলাত আছিলো ৭৭ টা তালুক। ইয়ার ভিতিরা ১৬টা তালুক আছিল সরকার কুচবেহারের অধীনত যার উত্তরপাকের আধা অংশ মোগলগুলার অধীনের জমিদারী হিসাবে কোচ রাজাগুলা দখল করিয়া আছিলো। আরো ১৭টা তালুক আছিল। জেলার উত্তর-পুব পাকে। এইগুলা একসমায় কোচ-হাজোর দখলত আছিলো; পরে মোগলগুলার অধীন হয়। বাকি ৩৩টা তালুকের বিষয়ে দেওয়া বুকানন সাহেবের বিবরণ থাকিয়া কোচ রাজবংশী মানষিলার ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার বিষয়ে জানিবার পাই। তার থাকিয়া আমরা জানিবার পাই যে, মৌসুমী ঋতুর সমায় কোচ রাজবংশীগুলা হেমতি ধানের খেতি করিছিল আর অস্থায়ী খেতিও করিছিল। বাড়িতে তৈয়ার করা সুতি কাপড়ের দ্বারায় কোনোসমায় খাজনা পরিশোধ করার টাকা যোগাড় করিছিল। নুন আর অন্যান্য কতোগুলান জিনিস বেচের বাদে কোনো জমিদারের একজনীয়া ব্যবসা আছিলো। এই বিষয়ে বিজনী জমিদারের কথা পাওয়া যায়। অইন্য পাকে রাজার অনুমোদন পাওয়া ব্যবসায়ীগুলার খালি জিনিস বায়রাত রপ্তানি করিবার পাইছিল। কোনো কোনো সমায় জমিদারগুলার তালুক চলেবার বাদে অইন্য সম্প্রদায়ের মানষি নেওয়াত উমরা রাজবংশী সাধারণ মানষিগুলাক শোষণ করারো সুবিধা পাইছিল।

রাজবংশী ধনী আর গরীব মানষিলার আর্থিক অবস্থা সমান না হয়। এক সমায় রাজবংশীলা মহাজনেরঠে হাওলাত নিয়া হালকিষ্যির কাজ করিছিল। খেত গোটার সমায় মহাজনের সুদ সুদায় ধান দেওয়া নাগিছিল। এলা সমাজব্যবস্থা বদলি যাওয়াত অনেক শিক্ষিত রাজবংশী জুয়ান ছাওয়া-পোয়া নানান বিভাগত চাকিরি-বাকিরি করিবার ধরিছে। খেত খামারের বেলাতও অনেক জাতের ধান, শাক-আঞ্জা আদির খেত করিয়া সাধারণ কৃষক মানষিলা বাচিয়া আছে। কিন্তুক অসমের রাজবংশীলা এলাও আর্থিকভাবে ভালে পাছেয়া আছে। সাধারণ হালুয়া মানষির অবস্থা খুবে খারাপ।

১৯১৩ সনত বির হওয়া মেগ্লগন কমিটির (Maglagan Committee) -র রিপোর্ট থাকিয়া জানা যায় যে, কোচ রাজবংশী লোক থাকা অঞ্চলগুলাত ‘মূলীঋণ’ আর ‘ভূতালী ঋণের’ চল আছিলো। মূলীঋণ হইল— নেওয়াইয়ায় আবাদ করা ফসলের দ্বারায় ঋণ শোধ করা আর ভূতালী ঋণ হইল— হালুয়ার ঋণ শোধ না-হওয়া পর্যান্ত মহাজনের জমিত বিনা পাইসায় খাটিবার ব্যবস্থা। হাজিরা ছাড়া খাটি দেওয়াত আপত্তি করিলে সউগ ঋণ নেওয়া টাকার উপুরা শতকরা ২৫ (পঁচিশ) টাকা হারে বছরে সুদ দেওয়া নাগিবে। এই ব্যবস্থাত সাধারণত কোচ-রাজবংশীলা এক সমায় আর্থিকভাবে নাজেহাল হয়া গেইচে। বিশেষ করিয়া পশ্চিম অসমের অবিভক্ত গোয়ালপাড়া জেলা আর উত্তরবঙ্গ অঞ্চলের রাজবংশী বসতি অঞ্চলত এই ব্যবস্থা ভালেখুনা প্রভাব ফেলাইছিল। রাজবংশী এলাকাত সেই সমায় ধান, কোষ্টা, সইষ্যা আদি ছাড়াও ফলমূল, জালুক, গোন্ধাফুল, সত্তরা ইত্যাদি উৎপাদন হওয়ার কথা জানা যায়। আফিং আর গাঞ্জারও খেতি করা হৈছিল। পাছত নীল খেতি আরাম্ভ হৈছিল। তারে উপুরা কাটোল, কলা, নারিকেলের ফলনও হৈচে মেলা। এলাও কোনো কোনো জাগাত এইগুলান খুব হয়। এক সমায় রাজবংশী এলাকাগুলাত খুব মাছ ধরা হৈছিল আর সেই মাছ শুকিয়া বাইরা রপ্তানি করা হৈছিল। ষোল্ল শতকত রাফফিচ কোচ রাইজ্য ঘুরিয়া সুতি কাপড় আর মৃগনাভি পাওয়া গেইছিল বুলিয়া উল্লেখ করে।

উল্লিশ শতকের পথম পাকে যেলা উত্তরবঙ্গর বিষয়ে বুকানন সমীক্ষা চলায় সেই সমায় বনজঙ্গল কাটিয়া আগুন ধরেয়া কোদাল দিয়া চাষের জমিন তৈয়ার করা হৈছিল। সেলা থাকিয়া লাঙলের দ্বারায় কোচ রাজবংশী লোকগুলা হেমতি ধানের খেতি আরম্ভ করিছিল বুলিয়া জানা যায়। অষ্টাদশ শতকের শেষাশেষি রংপুর আর দিনাজপুর অঞ্চলত যেগুলান মাছুয়া কোচ-রাজবংশী লোক আছিলো সেই অঞ্চলত দুর্ভিক্ষ হওয়াত বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, যশোর, মানিকগজ আর ময়মনসিংহ বুলিয়া চলি যায়। সেলা থাকিয়া উত্তরবঙ্গ আর পশ্চিম অসমক বাদ দিয়া অন্য জাগার যেগুলান কোচ রাজবংশী আছিলো উমরা খেতি কাজের সাথে সাথে মাছের ব্যবসাও করিবার ধরে বুলিয়া জানা যায়।

কোচ-রাজবংশী সমাজের যেগুলা ভূমিহীন গিরস্থ উমরা অইন্য কোনো কাজ করিয়া জীবন চলায়। অইন্য পাকে এলা সরকারের নেওয়া কতোগুলা কাজ তো রাজবংশীলায় করে। অনেক জাগার গরীব রাজবংশীলা শহরত ঠেলা, রিক্সা, দোকানের কাজ করিয়াও জীবন চলায়। তারে উপুরা এলা নিজের জাগা ছাড়িয়াও ভারতের নানান বড় বড় শহরতও কাজের খোজত যাবার ধরিছে। শিক্ষিত কতোগুলা জুয়ান চেংরা-চেংত্রীক সরকারী আর বেসরকারী অফিসকাছারিগুলাত কাজ করির দেখা যায়। বেটাছাওয়ার চাইয়া চাকরি-বাকিরি করা রাজবংশী বেটিছাওয়ার সংখ্যা খানিক কম।

রাজবংশী সমাজের বাপ-মাওগুলা ছাওয়াক আদরে যতনে বড় করি তুলির পাছত বুড়াবুড়ি হইলে ছাওয়ার কামাইর উপুরা ভর করিয়া জীবন চলেবার স্বপ্ন দেখে আর বেশিরভাগ বাপ-মাওয়ে বেটির থাকি বেটার উপুরা ভরসা করিয়া বাচিবার চায়। নিজের সংসারের বাদে রাজবংশীগুলা ধান, কোস্টা, কুশিয়ার, ডাইল, আঞ্জাপাতি ইত্যাদির আবাদ করে। কাঙো কাঙো কোস্টা, কুশিয়ার, ধান-চাউল, আঞ্জাপাতি, গুয়াপান, চুরামুড়ি আদির ব্যবসা করিও সংসার চলায়।

৩. রাজনীতিঃ কোনো জাতির সংস্কৃতির ক্ষেত্রত রাজনীতির কথাটা খুবে গুরুত্বপূর্ণ। এলা যে নাখানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেখা যায় আগতে তেমন না আছিলো। ঔপনিবেশিক শাসনের আগত কোচ রাজবংশী তল্লাটগুলাত রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা আর আইন-কানুন না আছিলো। অসমের পুরানা গোয়ালপাড়াকে ধরিয়া গোটায় উত্তরবঙ্গর রাজবংশী-তল্লাটত এই ব্যবস্থা বেশি আছিলো। এই অঞ্চলগুলাত এক-একটা জনপদত একঝন বা তার বেশি সমাজপতি বা জমিদারের দ্বারায় সামাজিক সমস্যা, অপরাধ আদির বিচার করা হৈছিল। উল্লিশ শতকের পথম ভাগত যেলা উত্তরবঙ্গর উপুরা নৃতাত্ত্বিক গবেষণা আরাম্ভ হয় সেলা ইংরাজ শাসনের আওতাত আনিয়া অনুন্নত অঞ্চল হিসাবে লিষ্টি করা হয়, যদিও শাসন ব্যবস্থার আওতাত আইসে অনেক পরে। বর্তমান পিথিবীর সউগ জাগাতে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার দ্বারায় পত্তিটা সমাজ চলে। কোচ রাজবংশীর সমাজও ইয়ার বায়রা না হয়।

রাজবংশী সমাজ রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার আওতাত আইসে বৃটিশ শাসনের সমায়। অবশ্যে তার আগতে মুসলমান শাসনের সমায়ওতো ইমরা কোনো কোনো শাসকক খাজনা দিছিল বুলিয়া জানা যায়। ষোল্ল শতকত মহারাজ বিশ্বসিংহ আর নরনারায়ণের রাজত্বের সমায় উমার আইন আর শাসন চলিছিল। এলা ভারতের সউগ অঞ্চলের রাজবংশী লোকগুলায় গণতন্ত্রী শাসন ব্যবস্থার আওতার ভিতিরা আছে। তথাপি কোনো কোনো অঞ্চলের রাজবংশীগুলার ভিতিরা নানান ধরনের সমস্যা, সামাজিক অনুষ্ঠান গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজের মুরুব্বির দ্বারায় সমাধান করির দেখা যায়। এলা রাজবংশীলা দেশের জাতীয় রাজনীতিতও অংশ নেয়। বিভিন্ন দল বা সংগঠনের দ্বারায় অনেকে দলীয় রাজনীতিত ঢুকিয়া সাংসদ, বিধায়ক, সভাপতি বা সদস্যপদ নিলেও লোকসভা আর বিধানসভার সদস্য সংখ্যা খুবেই কম। অনেক জাগাত সংরক্ষণের দ্বারায়ও দুই একঝন বিধায়ক বা সংসদের পদ পাইছে। কোচ-রাজবংশীগুলা জাতীয় নির্বাচনত অংশ নিলেও বা ইচ্ছামত ভোটদান করিলেও রাজনৈতিকভাবে রাজবংশী মহিলা পুরুষগুলা চেতন হৈছে বুলিয়া করার না পাই। রাজনৈতিক জাগরণ আনার বাদে একসমায় কতোগুলান সংগঠন ‘চিলারায় সমন্বয় রথযাত্রা’ রা ‘রথযাত্রা র মতোন কাজ হাতত নিলেও সুফল পায় নাই। অইন্যপাকে কামতাপুর পিপল্স পার্টির মতোন রাজনৈতিক দল গড়ে তুলিও কোনো ফল ধরে নাই। রাজনৈতিকভাবে চেতন হবার গোনে হয়তো-বা এই জনগোষ্ঠীটাক আরো অনেক সমায় নাগিবে।

৪. সমস্যা আর সংগ্রাম : কোচ রাজবংশীলার নানান জাগাত নানা ধরনের সমস্যা দেখা যায়। সমস্যাগুলা সমাধানের বাদে ইমরা আন্দোলনও করে না যে সেটা না হয়। ইমার মূল সমস্যা হৈল-ভাষিক, সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষা। আর অসমত জনজাতিকরণের সমস্যা। এই সমস্যাগুলার বাদে নানান জাগার অ-রাজনৈতিক সংগঠনগুলা নানা ঢক করি আন্দোলনের কার্যপন্থা নিয়া থাকে। রাজবংশীলার এমন সামাজিক সংগঠনগুলার কয়টার নাম হইল – অসমত— কোচ-রাজবংশী সম্মিলনী, কোচ রাজবংশী মহিলা সম্মিলনী, যুব ছাত্র সম্মিলনী, কোচ-রাজবংশী ছাত্র সন্থা, কোচ-রাজবংশী সাহিত্যসভা, রাজবংশী সাহিত্যসভা, রাজবংশী-ভাষা-সাহিত্য পরিষদ, কোচ-রাজবংশী কৃষ্টি সম্মিলনী ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গ তথা উত্তরবঙ্গত — চিলা রায় সেবা পরিষদ, ফাউন্ডেশন ফর সোসাল সায়েন্সেস এণ্ড রিসার্চ, রাজবংশী একাডেমী; নেপালত— রাজবংশী ভাষা প্রচার সমিতি, বিহারত— রাজবংশী ভাষা কল্যাণ পরিষদ এইলা উল্লেখযোগ্য। এই সংগঠনগুলা বেসরকারীভাবে কোচ রাজবংশীগুলার ভাষিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক সমস্যাগুলা সমাধানের বাদে সভাসমিতি, আলোচনাচক্র, বইপুস্তক, পত্রিকা, স্মৃতিগ্রন্থ ইত্যাদির দ্বারায় সমস্যাগুলাক তলথি ধরার চেষ্টা করি আসির ধরিছে। অইন্যপাকে কতোগুলা সংগঠন, বিশেষ করিয়া অসমের কোচ রাজবংশী সম্মিলনী, কোচ-রাজবংশী ছাত্র সন্থা, মহিলা সম্মিলনী, যুবছাত্র সম্মিলনী ইত্যাদি সংগঠনগুলা অসমের কোচ-রাজবংশীলার জনজাতির মর্যাদা আদায়ের বাদে ভালেদিন ধরিয়া আন্দোলন করিয়া আছে। কোচ রাজবংশী ছাত্র সন্থাদোসরা ‘কামতাপুর’ রাজ্যর দাবীও করিয়া আসির ধরিছে। তার বাদে ইমরা হরতাল, ঘাটাবন্ধ, রেল-আটকা, অনশন করিয়াও দাবীপূরণের চেষ্টা করে। অসমের কোচ রাজবংশী সম্মিলনী ১৯৬৭ সাল থাকিয়া এই জনগোষ্ঠীটাক জনজাতির তালিকাভুক্ত করার বাদে দাবী করি আসির ধরিছে। ১৯৮০ সালত মেঘালয়ত বসত করা কোচগুলাক জনজাতির তালিকাভুক্ত করার বাদে দাবী জানেয়া একটা প্রস্তাব ভারত সরকারক পেঠায়। সেই মর্মে ১৯৮৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মেঘালয়ের কোচগুলান জনজাতির তালিকাভূক্ত হয় আর পরের লোকসভাত বিল হিসাবে পাশ করে। ঐ বিলের অধ্যাদেশখানত মেঘালয়ত বসত করা কোচগুলাক তো করেয়, তার উপুরা বড়োকাছারী আর রাভাগুলাকও জনজাতির তালিকাভুক্ত করে। অইন্যপাকে অসমেরকোচ-রাজবংশীগুলাও ১৯৯৬ সালত অধ্যাদেশ নং- ৯, ১৯৯৬ যোগে ২৭ জানুয়ারিত জনজাতির তালিকাভুক্ত হয়। কিন্তুক রাজনৈতিক অভিসন্ধির বাদে তিনবারত-ও তার নবীকরণ হয় নাই। অধ্যাদেশ নং-২১, ১৯৯৬ খান বিল আকারে উত্থাপন হয় আর সংসদীয় বাছনি সমিতি ১৯৯৭ সনের ১৪ জানুয়ারিত অনুমোদন জানেয়া রিপোর্ট দাখিল করে যদিও আজি পর্যান্ত নবীকরণ না হওয়া অবস্থাতে আছে। ফলে আজি পর্যান্ত অসমের কোচ-রাজবংশীগুলা জনজাতির মর্যাদা পায় নাই। ৪র্থ অধ্যাদেশ-৩, ১৯৯৭ খান নবীকরণ না হওয়াত এই জনগোষ্ঠীটা সেই সমায়কার ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রকুমার গুজরালের নেতৃত্বাধীনমোর্চা সরকারের দিনত প্রতারিত হয়। ফলে উক্ত জনজাতিকরণের সমস্যার সমাধান না হৈল। আজি পর্যান্ত একমাত্র কোচ রাজবংশী জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রত চাইরবার অধ্যাদেশ জারি করিয়াও উমরা জনজাতির মর্যাদা না পায়। জনজাতি করার বাদে সরকারের কোনো সিদ্ধান্তর ঠিকঠিকিনা নাই, ফলে সমস্যা হয়য়ায় ঝুলিয়া আছে।

অসমের কোচ-রাজবংশী ছাত্র সন্থা ভালেদিন থাকি কামতাপুর নামে এখান রাইজ্য গড়েবার বাদে দাবী করিয়া আছে। এই ক্ষেত্রত ইমরা নানান ধরনের আন্দোলন করিও সুফল পায় নাই। বৃটিশের আমলত অর্থাৎ ১৭৭৪ খৃষ্টাব্দর ৫ এপ্রিলের চুক্তি অনুযায়ী বৃটিশের তলত যে কমতাপুর রাজ্য আছিলো আর ১৯৪৭ সনের ১৪ আগস্টত উক্ত চুক্তি বাতিল করিয়া লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সুপারিশত বৃটিশ পার্লামেন্টত যে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাশ হৈছিল তার ৮নং ধারা মতে কুচবেহার স্বাধীনতা আর সার্বভৌম ক্ষমতা অর্জন করে। কিন্তুক ১৯৪৯ খৃষ্টাব্দর ১২ সেপ্টেম্বরত ঐ রাজ্যর শেষুয়া রাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুর ভারতের সাথত সামিল হয়। সেই রাজ্য নয়া করি উদ্ধারের বাদে অসমের কোচ রাজবংশী ছাত্র সন্থার সাথতে কামতাপুর ছাত্র সংগঠন আর কামতাপুর অ্যাসোসিয়েশন আন্দোলন করিয়ায় আছে। এই ক্ষেত্ৰতও অনেক সমস্যা দেখা যায়। এই সমস্যার গঠনমূলক সমাধানের বাদে রাজ্য সরকার অথবা ভারত সরকার আন্দোলনকারী কোচ-রাজবংশী জনগোষ্ঠীর সংগঠনগুলার সোদে কোনো ধরনের বৈঠক করার আগ্রহ কোনদিন দেখায় না। এই সমস্যাগুলার যে কোনোদিন সমাধান হবে তার অপেক্ষাত সগায় বাচ্চেয়া আছে।

খুঁজি নেওয়া— ভোগা (পহিলা সংখ্যা, কাতি ১৪২১) সম্পাদক: নিখিলেশ রায়। প্রকাশ: রাজবংশী ভাষা আকাদেমি।

1 Comments

Previous Post Next Post