সমসাময়িক রাজবংশী উপন্যাস: পরিপ্রেক্ষিত ও পর্যালোচনা —ড. গিরীন্দ্রনারায়ণ রায়

সমসাময়িক রাজবংশী উপন্যাস: পরিপ্রেক্ষিত ও পর্যালোচনা
ড. গিরীন্দ্রনারায়ণ রায়

পত্তিটা জাতি বা মানবগোষ্ঠীয়ে উমার সামাজিক আর সাংস্কৃতিক জীবনের বিকাশের ধারাত এক সমায় উমার নিজস্ব একটা আইখ্যান-পরিসর খুঁজি পায়। পিত্থিমির সউগ সাহিত্যতে এইটা লইক্ষ্য করা যায় যে, আইখ্যান বা উপন্যাস সাহিত্যর একটা রূপ হিসাবে উপজন হইছে অনেকটায় পাছোত, কওয়া যায় অনেকটায় আধুনিক যুগত। ইয়ার আগত যে উপ্‌গিলার মইধ্য দিয়া মানষি নিজকে পরকাশ করিছিল সেগিলার মধ্যত লোকগানে পধ্যান। কিন্তুক লোকগানের মধ্যতও আছিল লোকনাটক, আর এই লোকনাটক বা পালাগান গান-পধ্যান হইলেও উপস্থাপিত হইছিল কিছু পরিচিত বা উদ্ভাবিত আইখ্যানের মইধ্য দিয়া। সেই জন্যে কওয়া যায় সমাজের ও সংস্কৃতির বিকাশের একটা সমায়ত যেমন গান আছিল, গান্ক ঘিরি কবিতা আছিল। তেমনে আছিল প্রচলিত গল্ফ, আইখ্যান বা কাহিনী না হয় কিচ্ছা। এইটাকে মুই কবার চাং আইখ্যান পরিসর (Narrative Space), যা একটা পর্যায়ত উপন্যাসের রূপ ধারণ করে। হিটা একটা সাংস্কৃতির বিকাশের স্তর যেলাসেই সমাজের মানযি জীবন আর শিল্পের দ্বান্দ্বিকতা আর পারস্পরিকতার মধ্য দিয়া নিজকে অতীত-বৰ্ত্তমান-ভবিষ্যতের সামগ্রিকতাত বুঝিবার চেষ্টা করে নাহয়তায় আবিষ্কার করে। কাজে একটা উপন্যাস খালি একটা বড় গল্ফয় না হয়। হেটা একটা পরিসর যেটা দর্শন ঘটায়, বিকাশ ঘটায় বা কওয়া যায় একটা মানবগোষ্ঠীর জাতিসত্তাক কল্পনা করিবার পথ সহায় করে।

মূল আলোচনাত যাবার আগত কয়টা প্রয়োজনীয় কাথা করার চাং। রাজবংশী একটা সুসংহত জাতি হিসাবে আজি উঠি আইচ্চে, ইয়ার পাছত্ আছে এই জাতির জীবনধারা যেটা একটা সুনির্দিষ্ট রূপ ধরি ফুটি উঠিচে ইয়ার সিরিষ্টিশীল শৈল্পিক জীবনত। এই শৈল্পিক জীবনটা তৈরী হৈচে মূলত শিল্পের লোকধারার উপর ভিত্তি করি। যাক মৌখিক সাহিত্য হিসাবেও কওয়া হয়। এই ধারাটা খুবে পুরানি। ইয়ারে কিছু কিছু পরবর্তীত ধীরে ধীরে লিখিত রূপও নেয় যেমন রতিরাম দাসের জাগগান। কওয়া দরকার যে, লোকধারার এই চৰ্চাত কিন্তুক গোষ্ঠীবদ্ধতা প্রধান আছিলো না, অর্থাৎ খালি রাজবংশী মানষিই ইয়ার চর্চা করে নাই, চর্চা করিছিলো একসমায়ের এই গোটায় অঞ্চলের তামান গোষ্ঠীর মানষি। ইয়াক হামরা কবার পারি সাংস্কৃতিক প্রাধান্য। যাক আজি হামরা রাজবংশী বুলি কবার ধরিচি সেদিনকার আবহাওয়ত্ উয়াক কামতা-কামতাভাষা-সংস্কৃতি বুলি কইলে প্রকৃত পরিস্থিতিটাক অনুধাবন করা যায়। চর্যাপদ থাকি শুরু করি কুচবেহার রাজসভার সাহিত্য বা তার পরবর্তীকালের যে লেখাগিলাত রাজবংশী ভাষার রূপ ধরা পড়ে সেলা কিন্তুক তৎকালীন সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানষির, খালি রাজবংশী না হয়। এই বাস্তবতার কারণে বর্তমান সমায়ত ভাষা তথা জাতি সত্তার নাম, বা রূপ নিয়া যে দ্বন্দ্ব, বিতর্ক শুরু হইচে সেটা মোর আলোচনার বিষয় না হয়। মুই কবার চাং যে রাজবংশী ভাষাত সাহিত্য ধীরে ধীরে লিখিতরূপ নিবার করির ধরিল। ইয়ার পধ্যান রূপ কাইব্যয় আছিলো যেমন— গোপীচন্দ্রর গান, বা ময়নামতীর গান। এই মতন আইখ্যানধর্মী কাইব্য, নাটক, আরো আরো ধীরে ধীরে লিখিত ছোট গল্ফ বা folk tale-এর উপ ধরিল। সুসংগঠিতভাবে জাতিসত্তার ভাবনার নগত যুক্ত হয়া সাহিত্যর যে পরকাশ আজি হামরা লইক্ষ্য করি সেটার উপজনকাল সাধারণভাবে কওয়া যায় স্বাধীনতা-পরবর্তী সমায়ত। এই সমায়ত জন্ম হয় ক্ষুদ্র পত্রপত্রিকার যার মধ্যে দিয়া পরকাশিত হবার ধরে কবিতা, যাক হামরা ‘গীতিকবিতা' (lyric) বুলি জানি। নগতে উঠি আইসে আধুনিক ছোট গল্ফ আর সামাজিক নাটকের চখুত পড়ার নিচিনা সাহিত্যর ধারা দুইটা।

সাহিত্য উপজনের এই ধারাত উপন্যাসের আগমন কণেক পাছত। আগতে উল্লেখ করিচুং যে, পিখিমির সউগ সাহিত্যতে উপন্যাসের আগমন পাছত ঘটিচে। ইয়ার একটা কারণ এই যে, ইয়ার উপজনের নগত (ধনতান্ত্রিক) আধুনিকতার উপজন জড়িত, যেলা ব্যক্তি মানষির উদ্ভব আর গুরুত্ব সমাজত প্রাধান্য পাবার ধরে। সেই মানষিটার উত্থান, কর্ম আর প্রতিষ্ঠা/প্রস্থানের বিবরণের আধারত সমাজ-বিবরণের যে কাহিনী হোটায় উপন্যাসের উপ গরহন করে। ইউরোপীয় সাহিত্যত উপন্যাসের উদ্ভব আর বিকাশক এই ভাবতে দেখিচে লুকাচ বা আয়ান ওয়াটের মতন কিছু সমালোচক, যদিও দোসরা আরো একটা দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায় বাখতিনের আলোচনা থাকি। বাখতিনের আলোচনাত উত্তর আধুনিক ভাবনাচিন্তার আদল হিসাবে উঠি আইসে ব্যক্তি সত্ত্বার বিপরীতে অপর সত্তা তথা ইয়ারে অনুসারী ভাবনা বহুস্বরূপতা—ঝা নাকি উপন্যাসের অনন্য বৈশিষ্ট্য। বাংলা উপন্যাসের উপজন আর বিকাশ পাশ্চাত্য উপন্যাসের ঘাটা ধরি— ঝার একটা বিশেষ রূপ হইল ব্যক্তি-আশ্রয়িতা যাক কওয়া হইচে 'বিডুড্সরোমান' (Bildungsroman)। মহাকাব্যিক-আশ্রয়িতা থাকি মুক্ত হবার প্রচেষ্টাত্ উপন্যাস মূলতঃ হয়া উঠিছিল পধ্যান বা কেন্দ্রীয় চরিত্রটার জীবনীর নাখান। বলাবাহুল্য, আধুনিক যুগত্ তথা মধ্যবিত্তর উত্থানের যুগত এই নাখান ব্যক্তির উঠি আইসা বিকাশ, প্রতিষ্ঠা বা প্রস্থানে হইল উপন্যাসের মৌল কাথা।

যে আর্থ সামাজিক আর সংস্কৃতিক পরিমণ্ডল স্বাধীনতার পাছের দশকগিলাত রাজবংশী জনজীবনত ধীরে ধীরে তৈয়ারী হৈচে তাতে তাত্ত্বিকভাবে কওয়া যায় যে, উপুরাত কওয়ার নাখান উপন্যাস অর্থাৎ ‘বিডুওরোমান' রাজবংশী সাহিত্য ক্ষেত্রঅবশ্যয় সিজ্জন হবার পারে। রাজবংশী জনজীবনত যেমন মধ্যবিত্তর উত্থান হইছে তেমনে ঘটিচে একটা লইক্ষ্য করিবার মতন আন্তঃসাংস্কৃতিক বিনিময়। নগতে আছে জাতিটার উঠি আইসার, জাগরণের বা পরিচিতি প্রতিষ্ঠার আবেগ। এইগিলা রাজবংশী উপন্যাসের বিষয়বস্তু স্বাভাবিকভাবে হবার পারে। উল্টাপাখে, বেমিশাল না হইলেও আছে একটা সুন্দর, গ্রাম্য, প্রকৃতি নির্ভর, মৈষালী, ভাওয়াইয়া, চোরচুন্নি, বিষহরাত্ ডুবি থাকা কল্পনার একটা অতীত বর্তমানের মাখামাখি জীবন। স্বাভাবিক ভাবতে উপন্যাসত্ এই দুয়োটা রূপেরে পরকাশ ঘটির পারে। যে কয়টা রাজবংশী উপন্যাস মোর হাতত আইচ্চে মুই দেকিচুং তাত এই নাখান পরকাশে ঘটিবার ধইচ্চে। এই ছবিটা আরো পষ্ট রূপ পাবে এই প্রচেষ্টাটা যেলা আরো অগ্রসর হবে। বাংলা ভাষাত এই সমাজক ভিত্তি করি যে কয়টা উপন্যাস বা বড় গল্ফ নেখা হইচে তার মধ্যত মোর জানা কয়টা উল্লেখ করির পারোং; যেমন— অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘মহিষকুড়ার উপকথা’ আর ‘দুখিয়ার কুঠি’, দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, অভিজিৎ সেনের ‘দেবাংশী’। এ যাবৎ রাজবংশীত নেখা গল্ফ আর উপন্যাসগিলার (মোর জানা) নগত যদি উপরত উল্লেখ করা বাংলা উপন্যাসগিলার উপস্থাপন তুলনা করা যায় তাহইলে একটা জিনিস চখুত পড়ে। উমরা বাংলার সাংস্কৃতিক আধিপত্যর অবস্থান থাকি উমার গল্ফক সাজায়। রাজবংশী জীবন আর চরিত্র গল্ফত্ সংযোজিত হয় আন্তঃ-সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রেক্ষিত তৈয়ারীর প্রয়োজনত, আর বেশির ভাগ সমায়তে এই চরিত্রগিলা বা আইখ্যানগিলা মৌল গল্ফর নগত প্রান্তিক এমনকি হেটাস্থানিকভাবে জোড়া। উপরের বাংলা উপন্যাসগিলাত এই সাধারণ রূপটা বজায় থাকিলেও রাজবংশী চরিত্র আর আইখ্যানের মৌল প্রাধান্য এগিলাত দেখা যায়। রাজবংশী জীবন আর সংস্কৃতিক সাধারণ সমাজের নগত দ্বন্দ্বপূর্ণ ও সহযোগিতার আবহত যেমন দেখার মানসিকতা আছে তেমনে আছে ইতিবাচক আর নেতিবাচক প্রস্থানের মিশালি। পত্তিটা উপন্যাসের বিষয়বস্তু, আঙ্গিক আর দৃষ্টিভঙ্গি যেহেতু দোসরা দোসরা সেই জন্যে ইয়ার চাইতে আর বেশী সাধারণ মন্তব্য ঠিক না হয়। মুই উল্টাপাখে রাজবংশী গল্ফ বা উপন্যাসের বিষয়বস্তু আর উপস্থাপনার পার্থক্যটা লইক্ষ্য করিবার চাং।

রাজবংশী গল্ফ, উপন্যাসত্ লইক্ষ্য করিবার বিষয় হইল বিষয়বস্তুর দিক থাকি ইয়ার গোষ্ঠীর জীবন কেন্দ্রিকতা। বেশীর ভাগ চরিত্র আর পটভূমি যে সমাজের মধ্যত চলাফিরা করে বা কর্মকাণ্ডত জড়েয়া থাকে তা মূলতঃ রাজবংশী সমাজ। বৃহৎ সমাজের নগত আদান প্রদান, সমন্বয় বা সংঘাত ইয়ার মৌল নিয়ামক শক্তি না হয়। মূল স্রোতের কিছু নেখাতে বরং ইয়ার পরকাশ বেশী ঘটে। এটা একটা ইঙ্গিতে বহন করে যে, আন্তঃসাম্প্রদায়িক, বা আন্তঃসাংস্কৃতিক-ভাষিক দ্বন্দ্ব এই সমাজত মৌল বিষয়বস্তু না হয়, অন্ততঃ যে গ্রামীণ সমাজক নিয়া বেশীর ভাগ গল্ফ-উপন্যাস নেখা হইচে তার মধ্যত। এটা কাথা কিছুদিন যাবৎ ভাষা সংস্কৃতির পরিচিতির প্রশ্নত যে আন্দোলন উঠি আইচ্চে তাক মনত্ থুইয়াও কওয়া যায়। এলকার কিছু নেখাত এই বিষয়টার ইঙ্গিতও যে আছে তার আলোচনাও হামরা এই নেখার পাছের অংশত আনিমু। কিন্তুক জীবন আর সংস্কৃতির যে গভীরতা থাকি সাহিত্য উঠি আইসে তাত খালি বর্তমান না থাকে, তার চাইয়া বেশী থাকে স্মৃতি,অতীত, ইতিহাস। বড় চায়া রাজনৈতিক ভাবনার ছক ও দ্বন্দ্ব সবসমায় দৈনন্দিন জীবনের বোধক পর্শ করে না। এই আত্মসমাহিত অবস্থা অর্থাৎ আপন সংস্কৃতির, সমাজ আর পরিমণ্ডলত বিচরণমুখিতা সাধারণভাবে বেশীরভাগ গল্ফ আর উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য বুলি কইলে প্রশ্ন উঠে তা হইলে কি রাজবংশী সমাজ থাকি উঠি আইসা আধুনিক যুবক/যুবতী ঝায় কোন উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র হবার পারে উমার কি কোন সংকট নাই? মোর মনে হয় সেই সচেতনতা এলা নানান সংঘাতের কারণে আস্তে আস্তে মতাদর্শগতভাবে উঠি আসির ধইচ্চে। হামার আলোচনাত এটা কাথাও আসিবে কারণ ভগীরথ দাস আর তারামোহন অধিকারীর উপন্যাস হামার চিন্তাত আছে। অর্থাৎ একটা বিবর্তন রূপ-চিন্তার-আঙ্গিকের ইনারে ভিতিরা প্রকাশ পাবার ধইচ্চে। এইঠে দলিত সাহিত্যর নগত রাজবংশী সাহিত্যর পার্থক্যটা বিশেষ করি চখুত পড়ে। মারাঠি দলিত সাহিত্য আর পরবর্তী সমায়ত অইন্য ভাষাত নেখা যে দলিত সাহিত্য আজি সগারে পরিচিত, তার মৌল দ্বন্দ্বটায় হইল উচাজাতের মানষির নিচাজাতের মানষির উপুরা যুগ যুগ ধরি চলি আইসা সামাজিক, ধার্মিক, অর্থনৈতিক তথা দৈহিক অত্যাচার আর অবিচার। এই বিষয়বস্তুর . কারণে যে সাহিত্যিক রূপটা ঐঠে পধ্যান রূপ হিসাবে উঠি আইচ্চে সেটা হইল 'দলিত আত্মজীবনী’ ইংরাজীত ‘Testimonies' হিসাবে পরিচিত। এটা কওয়া যায় একটা বিদ্রোহী সাহিত্য ইংরাজীত 'Protest literature' যার মৌল সুর সামাজিক ন্যায় আর প্রতিষ্ঠা। রাজবংশী সাহিত্যত বিদ্রোহের যে সুর এলা উঠি আসির ধইচ্চে বুলি কচুং সেটা কিন্তুক মূলতে সাংস্কৃতিক পরিচিতির।

যাইহউক পরিপ্রেক্ষিত হিসাবে এই কয়টা কাথার পাছত্ এলা হামরা উপন্যাসগিলার কাথাত আসি। রাজবংশী ভাষাত পথম উপন্যাস কোনটা সঠিক না জানোং, তবে শুনিচু বীরেন রায়র ‘ভোকস’ হইল এই ক্ষেত্ৰত পথম প্রয়াস। এই বইখান মুই এলাও দেখির পাং নাই, পরকাশের সমায়কালও না জানোং। যে পাঁচখান উপন্যাস মোর এই আলোচনাত খান পাবে পরকাশের সমায় সুদায় সেগিলাক্ মুই উল্লেখ করিলুং ১) গোকুলকুমার রায় – ‘সতী সুনীতি' (১৯৮১), ২) ভগীরথ দাস—সেন্দুকের ছোড়ানি' (২০০৬), ৩) তারামোহন অধিকারী – ‘আসামী’ (২০০৬), ৪) অভিজিৎ বর্মণ— ‘বাথান' (২০০৯), ৫) পরেশচন্দ্র রায়—'বাতাসির বাসিয়া কাথা' (২০১২)।

১৯৬০এর দশকের শুরুর সমায় থাকি রাজবংশী ভাষাত সাহিত্য সিজ্জনের একটা জোয়ার আইসে। পত্রপত্রিকা বাইর করিবার চেষ্টাও চলির থাকে। ইয়ার মাঝোত বিশেষ করি উল্লেখ করিবার মতন হইল কবিতা। ড. গিরিজা শংকর রায়ের সম্পাদিত 'সাতভাইয়া' পথম পরকাশিত হয় ১৯৬১ সনত। এটা কওয়া যায় রাজবংশী কবিতা সংকলনের একটা সার্থক পরথম চেষ্টা । এছাড়া আর একটা অইন্য প্রয়াসও উল্লেখ করিবার মত। সেটা হইল কলীন্দ্রনাথ বর্মণের ‘রাজবংশী অভিধান'। এই প্রয়াসগিলার মধ্য দিয়া যে জিনিসটা উঠি আইসে সেটা হইল নিজ ভাষা, সংস্কৃতি, ভূমির বাদে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর অধিকার চেতনা। সেদিনকার পরিপ্রেক্ষিতত সেটা সোতের উল্টায় আছিল। আর সেই কারণে আত্মবিশ্বাস আর সাহসিকতার পরিচায়কও ছিল। ইয়ার পাছত ১৯৭০এর দশক থাকি এই সাহস, আত্মবিশ্বাস আর মনোভাব কেমন করি আর কতটা আন্দোলনের রূপ নিছিল সেটা ইতিহাস হিসাবে সগারে কম-বেশী জানা আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতত সচেতনভাবে অনেকে রাজবংশী ভাষাত কবিতা, ছোট গল্ফ নেখা চলে যাওয়ার চেষ্টা বজায় রাখিছিলো। এই ধারাবাহিকতার মধ্যতে পরকাশিত হয় গোকুল কুমার রায়ের ‘সতী-সুনীতি’ ১৯৮১ সনত। ভাষা, সংস্কৃতি আর পরিচিতি চেতনাবিকাশের আরম্ভনির সমায়ত বইখান পরকাশিত হয় — সেই হিসাবে সমায়ের দিক থাকি ইয়াক অগ্রগামী বুলি কবার পারি। সেই জন্যে আজি যেলা চেতনা অনেকটায় অগ্রসর সেলা বইটাক হামরা নয়া করি আবিস্কার করিচি।

১৯৭০-এর দশকের যে নয়া চেতনা সেলা রাজবংশী জনগোষ্ঠীর একটা অংশক উদ্বুদ্ধ করিসিলো সেই প্রেক্ষাপটের ফসল হইলেও গোকুল রায়ের উপন্যাসত বিষয়বস্তুর দিক থাকি ইয়ার কোন ইঙ্গিত বা উপস্থাপনা নাই। অবশ্য নেখকে যে এই বিষয়ে সচেতন তার প্রমাণ কাহিনীর মইধ্য দিয়া পরকাশ করিচে। এই ভাষাত যে বই নেখা শুরু হইচে হিটার উল্লেখও আছে শ্রীকুমার আর মিনতীর আলাপনের মধ্যত। শ্রীকুমারের শক্ত যুক্তি আর বিশ্বাস পরকাশ পায় যেলা উঞায় মিনতীর কাথার উত্তরত কয়— ধু – ভাষা একটা সন্তানের নাখা। দ্যাশবাসী ইয়ার মাও। ইয়ার-অ যতনের, আদরের দরকার শ্রীকুমার

আছে দ্যাশবাসীর তরফ তকা, কিন্তু হামা করি না। মিনতী অনেকে অনেক কাথা কোবে এই নয়া ভাষা দেখিয়া।

শ্রীকুমার – তাতে কি যায় আসে? মানুষী না কয়্হা পারে। ভালো কাজতত্য শ শ বাধা। (পৃ.৩১)

কিন্তু আগোত কওয়ামতে, এই সব ভাবনা, চেতনা বা ঘটনা আর তার থাকি উঠি আইসা সামাজিক, সংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক যে জটিলতা সেটা কাহিনী বা উপকাহিনীর আকারত উপন্যাসটাত থান পায় নাই বা কুন প্রভাব ফেলায় নাই। শুধু কওয়া যায় যে, উপন্যাস লেখার প্রয়াস আর আগ্রহের মধ্যতও নেখকের চেতনার একটা বৈপ্লবীক পরকাশ আছে। কাহিনীত সংঘাত হিসাবে এই বিষয়গিলা, অনুপস্থিতি, বা আন্তঃসাংস্কৃতিক, সামাজিক আদান-প্রদানের জটিলতার অনুপস্থিতির কারণ অইন্য জাগাত খুজির নাইগবে। রাজবংশী ভাষাত যে গল্ফ বা উপন্যাসগিলা পরকাশ পাইছে বেশিরভাগের মইধ্যত যে জীবন, ছন্দ আর সুর পাওয়া যায় সেটা মূলতে রাজবংশী জীবন আর সমাজের মধ্যতে নিবদ্ধ— আন্তঃসাংস্কৃতিক বা সম্প্রদায়গত দেওয়া-নেওয়া নির্ভর না হয়। উল্টপাথে কোন বাঙালী। গল্ফকার বা উপন্যাসিক এই পরিপ্রেক্ষিতত গল্ফ নেখিলে এই দেওয়া-নেওয়ার সম্ভাবনা বেশী। কারণ হিসাবে কওয়া যায় যে, রাজবংশী গল্ফ আর উপন্যাসের পটভূমিত মূলতে গেরামের জীবন যা কিছুটা নিজ সংস্কৃতির আর সম্প্রদায় নির্ভর। গেরাম জীবনে মূলে রাজবংশী সম্প্রদায়ের প্রাধান্যহেতু সামাজিক-সাংস্কৃতিক দেওয়া-নেওয়া বড় হয়া দেখা না দেয়। দলিত সাহিত্যত যেমন জাত-ভিত্তিক শোষণ আর অবমাননার বোধটায় বেশীর ভাগ ক্ষেত্ৰত মূল বিষয়বস্তু – রাজবংশী সাহিত্যত সেটা বাস্তবতা না হবার কারণে অনুপস্থিত। স্বভাবতে যে চিত্রটা এই সবকয়টা উপন্যাসতে পধ্যানভাবে দেখা যায় সেটা হইল রাজবংশী সমাজের ভিতিরার ছবি, চরিত্র, ভাবনা, ভালোবাসা, সংসার জীবন। আর যেহেতু সাধারণ সমাজের নগত যোগাযোগ বিভিন্ন কারণে ঘটি থাকে তারও পরকাশ কিছুটা আসি যায়।

গোকুল রায়ের উপন্যাসের নাম ‘সতী সুনীতি'। নাম থাকি বুঝা যায় যে গল্ফের অন্যতম পধ্যান চরিত্র সুনীতি আর গল্ফটা উয়ারে সতীত্বত থান পাওয়ার চমকপ্রদ ঘটনাটাক ঘিরিয়া। গোটায় ছকটার মইধ্যত লোকজীবন আর লোককাহিনীর প্রভাব লইক্ষ্য না করি পারা না যায়। স্বভাবতে বিষয়বস্তু হইল প্রেমের, ত্রিকোণ প্রেম। শ্রীকুমারক ঘিরি দুইঝন নারী। ইয়ার থাকি উঠি আইসা প্রতিহিংসার জটিলতা, ভুলবুঝাবুঝি, কলঙ্ক। শেষত একঝনের মরি যাওয়া-আত্মত্যাগ বা মরণের মধ্য দিয়া গল্ফের সমাপ্তি। গেরাম জীবনের সহজ পরিবেশত সহজ আর স্বাভাবিক ভাবতে প্রেমক দেখা হইছে। ইয়ার মাঝত ভাবের গভীর কোন আদান-প্রদান দেখা হয় নাই, বা প্রেমের সম্পর্কর মইধ্য দিয়া পাত্র-পাত্রীর মানসিক বা চারিত্রিক বিকাশও গুরুত্ব পায় নাই। গীতার ভালোবাসার পরকাশ দেখা হইছে উঞার গোপন ডায়রিত–উঞার ভালোবাসা মনে মনে, নীরব ভাবত। ঘটনাচক্রে উঞার নগত শ্রীকুমারের বিয়াও হইল— না যদি হইল হয় মনে হয় না গীতার কোন বিশেষ লইক্ষ্য করির নাখান অভিব্যক্তি ঘটিল হয়। সুনীতিক কওয়া হইচে অস্থিরচিত্ত। উার ভালোবাসাও গভীর না হয়, নাহয় উঞায় কাহক-অ স্থির হয়া ভালোবাসির পারে না বুলি লেখকও মন্তব্য করিচে। তথাপি দেখা হইল উঞার ভালবাসা, আর ভালোবাসার জন্যে প্রতিহিংসা, প্রতিহিংসা শেষ পর্যান্ত ধ্বংসের কারণ হইল। কাথা হইল, কোনটা বেশী পরধান হিসাবে দেখা গেইচে উঞার চরিত্রত– ভালোবাসা না প্রতিহিংসা? ভালোবাসা হইলে অন্ধ শ্রীকুমারের ভিতি বিশেষ কোন আবেগ কেনে দেখা হইল না, কেনে ধনীঘরের মানষি বরুণক বিয়াও করি চলি যাইতে কোন অসুবিধা না হইল। নিজের প্রতিহিংসার জালত নিজে উঞায় বন্দী হয়। আর বিরিবার ঘাটা পাইল না। তাছাড়া যে নাখান করি গল্ফটা কওয়া হইছে তাতেও প্রতিহিংসাটা গভীর হওয়ার কোন বাস্তবিক পরিস্থিতি না দেখাইতে প্রতিহিংসা সুনীতির মনগড়া বুলি মনে— আর বিশেষ করি যেলা গীতাক একঝন নিষ্ক্রিয় (Passive) চরিত্র / প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে উপস্থাপনা করা হইছে। সন্তানসম্ভবা বুলি সুনীতিক যেলা উার স্বামী উঞার বাপের বাড়ী ফিরত পেঠাইল সেলা উঞার অনুতাপ আর আত্মহত্যা ছাড়া আর কোন চিন্তা বা পথ না আছিল। অনুতাপ এই কারণে যে উঞার প্রতিহিংসার জন্যে উঞায় একাধিক গুণ্ডাক ব্যবহার করিচে গীতার চরিত্রত কলঙ্ক আরোপ করির বাদে, আর নিজেও ব্যবহৃত হইছে সেই গুণ্ডাক নিজের শরীরটা দিয়া। উঞার গর্ভবতী হওয়ার জন্যে কলঙ্ক যায়া নাগিল শ্রীকুমারের চরিত্র। উঞার অনুতাপের কারণ উঞার নিজের ভুলের প্রচণ্ড মাসুল। কিন্তুক আগতে কওয়ামতে এমন গহীন একটা কাজের সিদ্ধান্তর জন্যে গল্ফত দরকারী পরিবেশ সিজ্জন করা হয় নাই। শেষ পর্যাপ্ত প্রশ্ন থাকি যায় সতী নামটা কি সার্থক? হিটা কি অনুতাপের জন্যে নাকি আত্মত্যাগের জন্যে? উঞার অনুতাপ হইছে ক্যানে আগতে উল্লেখ করা হইছে। সুনীতি উঞার স্বভাব আর পরিস্থিতির স্বীকার— উঞার অনুতাপ উঞার প্রতি সমবেদনা তৈয়ারী অবশ্যয় করে। যে চিঠিখান সব ঘটনা বর্ণনা করি উঞাক নিখিসিল তাতে উঞার পরিবর্তিত হবারে আভাস পাই। উঞার প্রতি সমবেদনা তৈয়ারী হয় সন্দেহ নাই, কিন্তুক গল্ফর গতি আর গঠন অইন্য একটা জিনিসক য্যানে বেশী করি তুলি ধরির প্রয়াস করিছে বুলি মনে হয়। সেটা হইল ঘটনাক্রমের এই নাখান অচমকা পরিবর্তনের মইধ্য দিয়া শ্রীকুমারক সচায় একঝন ভাল আর আদর্শ মানষি হিসাবে তুলি ধরা। মরণের আগত নিজের চখুলা উঞায় কেমন করি দান করি গেইল সেটা নে কের মনে হয় যেনে গল্ফর পরিসরত ঠিক মতন উপস্থাপন করির না পারিয়া ধোয়াশা রাখি দিছে। চখু দান করির জন্যে মৃত্যুবরণ, নাকি মরণটা আগতে যখন করি ফেলাইছে, তা হইলে চখুগিলা অন্ধ শ্রীকুমারক দিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্তয় সুনীতিয়ে নিল বুলি যেনে মনে হয়। তাছাড়া নিজের আত্মহত্যা/আত্মত্যাগের সিদ্ধান্তটা চন্দ্রাবতী যাত্রাগান দেখি উদ্বুদ্ধ হয়া দেখাটাও যেনে সুনীতির বিপইক্ষে চলি যায়। বইটাত তা হইলে মূল বিষয় কোনটা সুনীতির মিত্যু, নাকি শ্রীকুমারের সমাজের একঝন হয়া ওঠা? উঞার ছাত্রজীবন দিয়া বইটার আরম্ভন, বইটার শেষও উঞার সব বাধা-বিপত্তি, দুর্ভাগ্য পার হয়া সমাজত প্রতিষ্ঠা। তাহইলে? আর এটা করিবার যায়া নেখক মাত্রাছাড়া দুর্ঘটনা ব্যবহার করি সমাজ জীবন-ব্যক্তির জটিলতার বদলে অতিনাটকীয়তাক ভর করিছে। সংহত আর ঘনত্বপূর্ণ কাহিনী না হইলে উপন্যাস সার্থক হয় না। কবার কাথা এই যে, যে-জীবনটাক নিয়া এই উপন্যাস ঐ জীবনটাত ও আরো গভীর উপন্যাস রচনার সম্ভাবনা আছিল। তাছাড়া যেহেতু খালি গ্রাম্য জীবন তো দেখায় নাই— শহরও তো প্রসঙ্গক্রমে আসি পড়িচে। আগতে কওয়া হইচে গল্ফটার বিষয়, বিন্যাস আর গভীরতার কাথা বিচার করিলে ইঞার পরিসর আর ভাবনা লোককাহিনীর (folk tale) উপুরা উঠির পারে নাই। তবে ভাষার ব্যবহারের মধ্যত যেমন একটা পারদর্শিত লইক্ষ্য করা যায়, তেমনে আছে একটা বিশেষ অঞ্চলের ভাষা- আদলের সংগতিপূর্ণ প্রয়োগ। ভগীরথ দাসের ‘সেন্দুকের ছোড়ানি' (২০০৬) আর তারামোহন অধিকারীর ‘আসামী' (২০০৬), গোকুল রায়ের উপন্যাসের বিপরীতে রাজনৈতিক আর সামাজিকভাবে সমকালীন চেতনার উপুরা তৈয়ারী হওয়া উপন্যাস। কিন্তুক উপন্যাস দুয়োটার নেখার ধরন আলদা। দুয়োটার মইধ্যতে রাজবংশী সমাজ থাকি উঠি আইসা শিক্ষিত যুবক শ্রেণীর বঞ্চনা আর অধিকার সম্পর্কে চেতনার জাগরণ আর তার পরকাশ হিসাবে আন্দোলনমুখীতা তুলি ধরা হইচে। ‘Angry Young Man' এ হইল এই দুয়োটার মুখ্য চরিত্র।

ভগীরথ দাসের বইটার কাথা পথমে কওয়া যাবার পারে। কৃষ্ণমুখ হইল এই বইটার নায়ক চরিত্র। উঞায় এই সমাজ থাকি উঠি আইসা শিক্ষিত চেতনাসম্পন্ন আর সেইকারণে অন্দোলনমুখী একজন যুবক। উঞার মনত আছে অঘুন, দৃষ্টিত আছে ক্রোধের পরকাশ আর ভাষাত আছে শ্লেষ আর ব্যঙ্গ। উঞারে চেতনা থাকি কথক (narrator) কাহিনীটাক্ কয়া যাছে। সেই জন্যে বাক্যগিলা তীক্ষ্ণ, প্রশ্নবোধক আর কোনবেলা ‘না’-বাচক শ্লেষাত্মক। উদ্দেশ্য, আঘাত দিয়া নিন্দত্ থাকা মানষির চেতনাক জাগা, মানষিক আন্দোলনের মইধ্য দিয়া সংগঠিত করা, জাতির উত্থান ঘটা। এই প্রক্রিয়াত ঘটির থাকিবে কৃষ্ণমুখের-ও জাতির নেতা হিসেবে উত্থান। এই চেতনা আর জাগরণের অক্ষরেখা হইল ইতিহাস অর্থাৎ অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতক একসূত্রে বান্ধি ভাবা আর দেখা আর আপন বঞ্চনাক, অধঃপতনক লইক্ষ্য করা। অতীতটা আছিল হামার সমৃদ্ধি আর আধিপইত্যের, আর হামার রাজার কুচবেহারের রাজার— হামার গর্বের সম্পদ। কিন্তুক দিনকাল পালটি গেইছে। দেশ স্বাধীন হইচে। আর হামার স্বাধীনতাও ধীরে ধীরে শেষ হয়া যাবার ধইচ্চে। মূল সমস্যাক দেখাইছে অভিবাসন বা উদ্বাস্তু সমস্যা। দক্ষিণার ঘর আজি হামার সউগ কিছুর দখলদার। হামার জমি উয়ার লইক্ষ্য, হামার ভাষা উমার অপছন্দ। নাউয়াটারির ফাগুয়া জোতদার হইল কৃষ্ণ মুখের বাপ। সেই নাউয়াটারির পেরায় গোটায়টায় আজি দক্ষিণাঘরের দখলত— ‘সেই বাদে বুড়ার ঘর কয়, যে দেশটাত দক্ষিণায় সার। সেটায় বোল নাউয়া টারিত, দইখনার বাড়ি সারি সারি টারি টারি তামানলা, দেশি খালি গোটায় গেরামটাত্ চাইরপাঁচ ঘর তাঙ্কুবাড়িত খোসা দিবার নাকান। হাইলচাত্ গচে দেখো কেনে, দেওয়ানি দক্ষিণা যেটে খোয়ানি দেশি সেটে’ (পৃ.১১)।

সেই নাউয়াটারির নাম উমরা পরিবর্তন করি রাখির চায় ‘শোভাগঞ্জ’ ঠিক যেমন তুফানগঞ্জের দীঘলটারির নাম বদলে উমরা রাখিচে ‘লম্বাপাড়া'। এইলার নগতে আছে দেশী মানষিগিলার উপুরা অবইজ্ঞা। কৃষ্ণমুখ দুঃখ পায়। রাগ হয়। কৃষ্ণমুখ নাম পরিবর্তনের প্রতিবাদ করে। নাম পরিবর্তন বন্ধ করি দেয়। নগতে লইক্ষ্য করে ক্যাংকরি রাজবংশী যুবক আজি চাকরি জোটেবার না পারি দিল্লী বোম্বাই আর রাজস্থানত পরবাসী হইচে। পেটের ভাত জোগার করির তানে। চাকরির কাথা কৃষ্ণমুখক-ও শুনির নাগে ঐঠেকার দেওয়ানী মানষিগিলারঠে! ‘হোর বাহে কৃষ্ণ, তুই এইন্না কি কামাই করির নাগিচিস্ কাজ কামাই বাদ দিয়া খালি ঢুড়ালি করি বেড়াইলে কি চলে...’(১৩)। স্বভাবতয় এই যে বিপরীত চিত্র : একপাখে কাম নাই, মানষি যাবার ধরিচে দূরান্তর দেশত বাড়িঘর ছাড়ি, অইন্য পাখে কিছু অইন্যখান থাকি আইসা মানষির মাতব্বরি কৃষ্ণমুখক ব্যঙ্গাত্মক করি তুলে। রাগের পরকাশ চাপিয়া থুইয়া কাথা কবার হইলে মানষি তো ব্যঙ্গাত্মক হবে-এ :

পোচে দেওয়ানির ঘর— ‘তোর কামাইটা ফির কি যে আমরাগুলা দেকির না পাঙ। কৃষ্ণমুখ কয়— ‘সগারে কি কামাই দেকির পান। তা কন তো অতুল শিকদার পন্‌চাইত পঞ্চাতি ছাড়া কি কামটা করে?

—'ক্যানে রাজনীতি!

দেকির পান হিনা। তা তোমরাও ভালা উনার রাজনীতির সুদে থাকেন। সেটে পাইসা কোটে পায়! ঐনাকান যে পাঞ্জাবী যে গাত দেয়। যার বাদে হাটুয়ার তলত পেন্দোনের কাপড়ে দেকা না যায়?’(১৩)

এইমতন ভাবে রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানষির ক্রমাগত হীন আবস্থা — ধনীরঘর, ফাগুনা ধনী, পাগালু ধনী কাহয় আর ধনী নাই— অইন্যপাখে দক্ষিণারঘরের দাপ্‌দাপানি কৃষ্ণমুখের নাখান যুবকগিলাক নয়া দিশার সন্ধানত্ নিকিলির বাধ্য করে— উমার মনত বিদ্রোহের জুই জ্বলে। কিন্তুক রাগ চাপি থুইয়া সংগঠিত হবার নাইগচে। এই জন্যেয় কৃষ্ণমুখের আচরণ কাহো বুঝির না পায়। এই জন্যেয় উঞার চেতনার আলোকত্‌ নেখা এই উপন্যাসখানের ভাষা, শৈলী আর উপস্থাপনাতও উয়ারে পরকাশ। গল্ফটা উঞারে ক্রমাগত উঞার মানষিগিলার নেতা হিসাবে উঠি আইসার। সেই কারণে কোন সরলরৈখিক কাহিনীর ক্রমাগত পরকাশ না হয়— উপন্যাসটা হইল উঞার ঐ দোসরা ভূমিকাত দোসরা একটা ব্যক্তিত্ব হিসাবে উঠি আইসার একটা চিত্র। আর এটা তৈয়ারী হৈচে ছোট ছোট কিছু আখ্যানক (episode) তাৎপর্যপূর্ণভাবে হাইলচার নাখান পরপর সাজেয়া। এই নাখান উপন্যাসের আর একেনা বৈশিষ্ট্য নগতে থাকে সেটা হইল সমান্তরাল প্রশ্ন, ব্যাখা— ব্যাখ্যা আর প্রশ্ন। সেই কারণে ঘটনার, স্মৃতির পরপর উল্লেখ আছে কিন্তুক কোনটারে বিশদ বিবরণ নাই বা বিবর্তন নাই— প্রয়োজনও নাই। এটা যেনে একটা চিন্তাস্রোত বা স্বগতোক্তিমূলক উচ্চারণ। ফলে সমায়ের দিক হাতে কোনবেলা বা মন চলিয়া যায় অতীতত। কোনবেলা বা বর্তমানত, কোনবেলা বা ভবিষ্যৎমুখী। ইংরাজীত এটাক এক ধরনের Stream of consciousness বুলি কয়। কিন্তুক উদ্দেশ্য হইল শেষতএকেনা সংহত রূপের পরকাশ— বিশেষ করি অতীত আর বর্তমানের মইধাত অনেক বৈপরীত্য দেখেয়া ভবিষ্যতত করণীয় কি সেখেনা দেখে দেওয়া। খালি দেখেয়া দেওয়ায় না হয় কাজের ধরনত সেই নাখান শক্তি আর বোধ তৈয়ারী করা, সেই নাখান নেতা হিসাবে উঠি আইসা।

সেই জন্যে চাকরি না হয়। রাজনীতি। হবার নাইবে ডাঙোয়াল। হামরা একদিন আছিলোং ডাঙোয়াল, এলা হামরা না হয়, অইন্যে ডাঙোয়াল—

‘কোন বা ডাঙোয়াল হামারগুলাক খেদে নিয়া বেড়ের নাইচে, তামানলার ভিটাবাড়ি দালান আর খালি দালান হঞা আচে। আর হামারগুলা খালি চষে খাবার ধচ্চি, নিন পাড়ির নাগচি মইও চড়ি....।' (১৬)

‘সেইজন্যে কৃষ্ণমুখ ডাঙোর গচ হবার চায়। গচের বাপের কতা যেঙ্ করি কাঙোয় ভাবে না, কৃষ্ণমুখও চায় জোতদার বাপের নাও নিঞা নোয়ায়, নিজের তিনকালিয়া বুড়া দুবোর স্যাপো করি সেকান ভাঙ্গি ফেলে দিয়া নয়া একান দুবোর গড়ের। (১৪)

এই প্রতিজ্ঞার উপজন আর তার লালন-পালন, বৃদ্ধি আর কর্মক্ষেত্রত পরকাশে হইল উপন্যাসটার মূল বিষয়। এই প্রতিজ্ঞা আর মনোভাব থাকি, কৃষ্ণমুখের চেতনার আলোকোেত সমায়ের অক্ষরেখাত্ কোনবেলা অতীত্, কোনবেলা বা বতমানত যাওয়া আসার ভঙ্গিত কাহিনীটার আবর্তন। বাচ্চাবেলার কাথা যেমন আইসে, বিয়ার কাথাও আইসে। কিন্তু কাহো কৃষ্ণমুখের মনের তল পায় না। কিন্তুক জানে যে উঞায় রাজনীতি, পার্টি হিলাত নিমজ্জিত হইচে। উঞার রাজনীতির যে বোধ আর চেতনা এটা বুঝেবার জইন্যে বারেবারে অতীত আর বর্তমানের মইধ্যত ছেদ (discontinuty) দেখাইচে। হরিণ আজু হইলসেই মানষি যার কিচ্ছার মইধ্য দিয়া বারবার কুচবেহারের অতীত দিনগিলা, রাজার আমল উঠি আইসে, উঠি আইসে অতীতের নিজের সংস্কৃতি আর জীবন। এই চেতনার চাবিকাঠি উঞায় সগারে হাতত তুলি দিবার চায়।

উপন্যাসটা কৃষ্ণমুখের একক চিন্তার সোত হিসাবে থাকি যায়। উপস্থিত পরিস্থিতিত যে বহুস্বরতার সম্ভাবনা আছিল, সেটা অইন্য আরো চরিত্র সিজ্জন করি বা আখ্যানগুলার সাহায্যত তৈয়ারী করির চেষ্টা করে নাই। সেই কারণেয় আন্তঃসাংস্কৃতিক (cross-cul tural) সংঘাত বা জটিলতার ইঙ্গিতমাত্রই যথেষ্ট বুলি নেখকের মনে হইচে। তথাপি উপন্যাসটা ইয়ার স্বল্প পরিসরত যে জীবনচিত্র তুলি ধরিচে, যে ছন্দ সিজ্জন করিচে, যে ভাবজগৎটাক সঠিক শব্দ ব্যবহার করি পরিবেশন করিচে– সেটা প্রশংসার যোগ্য।

এই পরিপ্রেক্ষিতত একে সমায়ে নেখা হইচে তারামেহন অধিকারীর আসামী। যেটা ভগীরথের কাহিনীত উহ্য আছিল সেইটা বইয়ত পষ্ট ভাষাত উচ্চারণ করা হইচে, পষ্ট রাজনীতির ভাষাত, রাজনীতির আলোচনাত। যেইটা আছিল মনত সেইটা আসি পড়িল জনতার মইধ্যত। আর যত বেশী এটা হইচে তত উপন্যাসটা উঞার সাহিত্যগুণও হারে ফেলাইচে। এইবার বিষয়বস্তু ভাষা-আন্দোলন তথা আপন সংস্কৃতির পরিচিতি আর অধিকারের আন্দোলন। তাত্ত্বিক আলোচনা, যুক্তি, তর্ক সবে ঠিক আছে, কিন্তুক এমন ভরি ভরি তাত্ত্বিক আর ঐতিহাসিক আলোচনা যে চরিত্রগিলার ঘাড়ত চাপে দেওয়া হইচে সেইঠে একটা ফারাক থাকি যায়। কারণ সেই চরিত্রগিলার পটভূমি সেইনাখান করি বিশ্বাসযোগ্য ভাবে তৈয়ারী হয় নাই। পলিত, অজিত, সুকুমার, সরেন রহিম, রণজিৎ এই নাখান কয়ঝন জেলত বন্দী আসামী। ইয়ার মাঝত পলিত ভাষা-আন্দোলনের নগত যুক্ত হবার কারণে বন্দী। বাকিগিলা মিথ্যা ষড়যন্ত্রের শিকার। নেখক উমার মাঝত গল্ফ, আলোচনা আর নিজের নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করিবার ভঙ্গিত কাহিনীটাক তৈয়ারী করিচে। মূল কথক হইল পলিত। মূল অক্ষরেখা হইল গোটায় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বা তত্ত্ব আর ইতিহাসটাক তুলি ধরা, আর এটা করির তানে উমার মইধ্যত বিভিন্ন সমায়ত আল্লাপ-আলোচনার আসর। কিন্তুক কাথাগিলাক উদাহরণ দিয়া বত্তে তুলির নাখান প্রয়াসত্ নানান আখ্যানের সংযোজন। তাতে নিজের নিজের দুঃখের কাথা আছে, রাজনৈতিকষড়যন্ত্র ক্যাংকরি করা হয় তার বর্ণনা আচে। ভোট রাজনীতির নীতিহীনতার উদাহরণ আছে, অন্তর্দলীয় বা আন্তঃদলীয় হিংসা-প্রতিহিংসার অমানবিক ছবি আছে। অভিবাসন বা উদ্বাস্তু সমস্যা যেমন আছে, তেমনে আছে থানীয় মানষির বঞ্চনা। সেটা দেখাইচে রাজবংশী মানষির জমি হারেবার চিত্রটা তুলি ধরি— বিভিন্ন উদাহরণ বা ছোট ছোট আখ্যানের মইধ্য দিয়া। এই উপন্যাসটার বিষয়বস্তু দিক থাকি কাহিনীর বিবর্তনের ভিতিরার অক্ষরেখাটা হইল পলিত বা পলিতের নাখান অনেক রাজবংশী তথা থানীয় মানষির মোহভঙ্গ। তথাকথিত সাম্যবাদী রাজনৈতিক দলগিলার কাম-কাজের সোদে যুক্ত থাকা দিয়া ইমার অনেকেরে জীবন শুরু – পরে পলিতের মতন সগারে মোহভঙ্গ। ইয়ার পাছোেত নিজের রাজনীতির আবিস্কার, নিজের ভাষা-সংস্কৃতির অধিকার, এমনকি নিজের রাজ্যের অধিকার। পলিতে কইচে ক্যাংকরি আস্তে আস্তে জাতিসত্ত্বার আন্দোলনের তত্ত্ব উয়ারঠে ঝলঝলা হয়। উঠিল জে. ভি. স্টালিনের জাতি সমস্যা বিষয়ের নেখাটা পড়ি। ভগীরথের বইয়ত আছে জিতেন মাস্টার ঝায় সঠিকভাবে কৃষ্ণমুখক বুঝির পারিছিলো। আর এইঠে আছে নারান মাস্টার যার মাধ্যমে পলিত জানির পারে হামার নিজের ইতিহাস, জাতির ইতিহাস, বিশেষ করি কুচবেহার তথা গোটায় কামতাপুরের একসমায়কার প্রতাপশালী রাজাগিলার কাথা। যেগিলার কাথা তথাকথিত ইতিহাসত নাই। পলিত আবিস্কার করিল নিজের ইতিহাস, নিজের পরিচয় আর খুঁজি পাইল নিজের প্রকৃত রাজনীতি— সাংস্কৃতিক পরিচয়ের রাজনীতি, ভাষা প্রতিষ্ঠার নাইবা স্বীকৃতির রাজনীতি। সমকালীন সময়ত এটাক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসাবে সরকারে দেখিছিল আর দমন নীতি গ্রহণ করি আন্দোলনকারীগিলার উপুরাত জেল, মিথ্যা মামলা ইত্যাদির মাধ্যমে যে অত্যাচার চালাইছিলো এই বইটাততার একটা চিত্র ফুটি উঠিছে। কিন্তুক উপন্যাস হিসাবে সার্থক হবার নাগিলে বিষয়বস্তুর যে ধরনের শৈল্পিক ব্যবহার দরকার তা না থাকার কারণে পাঠক খবরের কাগজের নাখান রিপোর্টিং-এর বায়রা বিশেষ কোন সাহিত্যিক আনন্দ আর গভীরতা থাকি বঞ্চিত থাকে।

যে পরিবেশ আর পরিপ্রেক্ষিতত উপরের উপন্যাস দুইখান নেখা হইচে তাতে ইয়ার আঙ্গিক আর শৈলী নিয়া সউগ কাথা কওয়ার পাছত-অ কবার নাগে যে আন্তঃসাংস্কৃতিক, সামাজিক আর সাম্প্রদায়িক দেওয়া-নেওয়ার যে অবস্থা অতীত থাকি আজি-কালি পর্যাপ্ত এই অঞ্চলগিলাত আছে তাতে বোধায় কাহিনী আর চরিত্রের এই নাখান পরিবেশনের বায়রা কিছু করা বাস্তবতার অনুমতি সাপেক্ষ না হয়, কেনেনা, এই জনগোষ্ঠী এলাও অনেকটায় নিজের সাংস্কৃতিক-সামাজিক পরিমণ্ডলতে থাকির বাধ্য হইচে। বাঙালীর উপন্যাসত যেলা এই জনগোষ্ঠীর মানষিক দেখা যায়— বেশীর ভাগ ক্ষেত্রতে উমরা যেমন প্রান্তিক থাকি যায়, তেমনে ঘটে উল্টাপাখে রাজবংশী উপন্যাসত্ বা গল্ফত বাঙালী চরিত্রের বেলাত্‌। গোকুল রায়ের উপন্যাস এই স্বাভাবিক অবস্থারে ফসল। ভগীরথ দাস আর তারামোহন অধিকারী দুই যুগ পাছত একে ঢক করি ঐ স্বাভাবিক সমাহিতির মইধ্যতে থাকিয়ায় সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতাক তুলি ধরির প্রয়াস করিচে। যে-আন্তঃসাংস্কৃতিক সামাজিক দেওয়া-নেওয়ার ইঙ্গিত এইঠে আছে সেটা প্রান্তিক মাত্র। যে চেতনা অন্তরীণভাবে ছনছনা সেটা হইল, যে অতীতটা হামার ছিলো সেটা হারেবার ব্যথা। সেই ব্যথা থাকি ভবিষ্যৎমুখী রাজনীতি আর সেই ব্যথা থাকিয়ে অতীতচারণ দুয়োটায় ঘটে। পরবর্তী উপন্যাস অভিজিৎ বর্মণের ‘বাথান’ (২০০৯) হামাক সেই অতীতত্ ধরি যায়।

‘বাথান’-ত অতীত সেই দ্বন্দ্বহীন, জটিলতা না-থাকা, প্রকৃতি-নির্ভর কিন্তুক আপন লোকসংস্কৃতি, লোকগান আর লোকজীবনত চলি থাকা যে জীবন, যে কর্ম, যে ভাব ভালোবাসা তাক তুলি ধরা হইচে। এটা করির নাগিলে প্রকৃতির যে বর্ণনা দরকার আর ভাষার যে স্বাভাবিক সাবলীল পরকাশ দরকার সে সউগগিলায় এই উপন্যাসত হাজির থাকিয়া উপন্যাসখানক সফল করিচে। এটা যেনে হামার সেই গল্ফত বা আঈ-আবোর ঘরের ঠে শুনা সেই কিচ্ছাটায়। গল্ফর বা চরিত্র সিজ্জনের দিক থাকি সেই জন্যে কোন জটিলতা বা মনস্তত্ত্ব এইটে থাকিবার কাথা না হয়। এইঠে আছে কালু আর মালতীর লোককাহিনীসুলভ প্রেম, যে প্রেমের উপজন লোকগানের পারস্পরিক আকর্ষণত। কিন্তুক প্রেমের পরিণতিত যে চমক দিবার চেষ্টা নেখকে করিচে সেটা বাস্তবতার দিক থাকি আধুনিক করিবার চেষ্টা থাকিলেও অতিবাস্তবতার জন্যে শেষপর্যান্ত লোক-কাহিনির নাখানে থাকি যায়। যে সুরের টানত প্রেম, সেই সুরক ভালবাসি মৈষালী জীবনটাকে বেছি নিয়া মালতীক প্রত্যাখান। যাই হউক, ইয়াতে কোন কাহিনীগত ত্রুটি হয় না বরং নেখকের অন্য উদ্দেশ্য সাধন হয়। সেইটা হইল ভাবাবেগের গভীরতাটা আরো বাড়ে দেওয়া। বইটার আকর্ষণ হইল উয়ার ভাষার ব্যবহার যেইটা হারে যাওয়া সুর, শব্দ আর ছন্দটাক উদ্ধার করি আনিচে। হামার শহরের রাজবংশী মানষিগিলা এই বই থাকি নয়া করি ভাষাটাক রপ্ত করির পারিবে। উপন্যাসের যে পরিধি বা জটিলতা আর গভীরতা দরকার হয় তা ফির বিশেষ বিশেষ সমাজ আর জীবননির্ভর। তার উপুরা উপন্যাসের রূপ নির্ভর করে আর সেখেনা দোসরা দোসরা ক্ষেত্রত দোসরা দোসরা হয়। হামার জীবনের অতীতত বা আরো অতীতত গেইলে এই সরল রূপটাকে পাওয়া যাবে। অবশ্যে আরো অইন্য রূপও আছে। অভিজিৎ বর্মণের উপন্যাসত পধ্যান হয়া উঠিছে অতীত, যেইঠে সমাজজীবনের চাইতে বেশী উঠি আইচ্চে প্রকৃতি, বাথান জীবন, লোকগান আর প্রেম। পরেশচন্দ্র রায়ের উপন্যাসত্ বিবর্তিতমান একটা সমাজচিত্র পামু বুলি হামার আশা। এটা কওয়ার কারণ উপন্যাসখান একেনা ট্রিলজির আকারত্ ছকা যার খালি পথম খণ্ডটায় নেখা হইচে। উপন্যাসখানের নাম—‘বাতাসীর বাসিয়া কাথা’ ১ম খণ্ড ।

নিঃসন্দেহে কবার নাইবে পরেশচন্দ্র রায় ভাষা ব্যবহারের (তরাই অঞ্চলত মূলত: চলে) ক্ষেত্রত, কাহিনীর পরিকল্পনাত আর চরিত্র সিজ্জনত অসাধারণ ক্ষমতার পরিচয় রাখিচে। কাহিনীটাক খণ্ড খণ্ড আখ্যানের সাহায্যে গড়ি তুলিচে—ছোট ছোট চিত্র, যা গ্রামজীবনের বৈশিষ্ট্য, তাক জোড়া দিয়া দিয়া ক্যানভাসটাক পুরা করিচে। এই কিতাপখান ঝায় পড়িবে খুবে আনন্দ পাবে বুলি মোর বিশ্বাস। ট্রিলজির পরিকল্পনাত্ নেখা হইচে বুলিয়াগোটায় বিষয়বস্তুটাক অনুমান করির পারি মাত্র— মনে হয় ক্যানভাসটার পরিসর আর ব্যাপ্তি বড় হবে। যাই হউক, ‘বাতাসীর বাসিয়া কাথা’র পথম খণ্ড হামার এইঠে আলোচ্য, যে বাতাসীর কাথায় হবে এই উপন্যাসখান ‘আত্মজীবনী', তার মাত্র উপজন হইল এই পথম খণ্ডখান যেলা শেষ হইল। পথম খণ্ডখান সেই অৰ্থত বাতাসীর উপজনের তথা উঞার পারিবারিক পটভূমি।

পেনকেটু আর চিল্কিশ্বরীর ছাওয়া হৈল বাতাসী। কিন্তুক এই পেনকেটু বা কায়, আর চিলকেশ্বরীই বা কায়। পেনকেটু— কিতাপখানের শুরুতে কওয়া হইচে–ইনায় একঝন নামিক্কর গরুর দার্হাল আর এই দার্হালি উঞায় শিখিচে উঞায় ঝাক গুরু বুলি মানে সেই খৈইরুল মিঞারঠে। দেখা যাবে ইমার সগারে উত্থান-পতন ক্যাং করি একে অপরের নগত জুড়ি আছে, ক্যাং করি গুরুয়ে শিষ্যর সর্বনাশ করে, ক্যাং করি পার্টি নামক রক্ষক বস্তুটায় ভক্ষক হয়া উঠে, ক্যাং করি মানষি নিজের নিজের স্বার্থত চলে, যেমন যার গুরু! অধিকারী সেও নিজের স্বার্থর কাথায় ভাবে— এইনাখান বস্তুগিলা দিয়া পাকদেওয়া, দ্যাবর-খাওয়া গেরামের বা কওয়া যায় গেরাম শহরের মইধ্য সিমিনাত থাকা জীবনখানক বেইশ রসেয়া রসেয়া নেখকে তুলি ধরিচে।

পেনকুটুর বাপ মাকাই সিংহ মাও নয়নশ্বরী। বাপটা উঞায় ছোট থাকইতে মৈচ্চে। মাওয়েরঠে মানষি হইচে–তবে মাওয়েরঠে শুনিচে যে বাপটা নাকি নামিক্কর গীদাল আছিলো। চিলকিশ্বরীর কাথাও আছে— মাও জলশ্বরী নামিক্কর গীদালী, বাপ গনি চুমকা সাধারণ গিরস্। চিলকিশ্বরীর ছোট বেলাটা রাজগৈনের শুট্‌কাপাড়াত কাটিচে, হাইস্কুলত এক-দুই বচ্ছর পড়িছিল। উঞার ছোট মামায় হইল পানিয়া। আর আছে খইরুল, যাক পেনকেটু উঞার দারহালি ব্যবসাত্ গুরু বুলি মানে। উঞার জীবনের ছোটবেলার নিদারুণ কষ্ট আর তারপর বুদ্ধি আর ভাইগ্যবলে উপুরাত ধীরে ধীরে উঠার কাথাও অল্পতে বাতে দেওয়া হইছে। গরুর দারহালি থাকি ধীরে জমির দারহালি, তার মইধ্য দিয়া পার্টি থাকি সউগ ধরনের মানষির নগত যোগাযোগ আর কারবার উঞার যেনে ক্যারিয়ারটা বদলি দেয়। কিন্তুক তারে সোদে নেখক সমাজের উপুরাত উঠার সিড়িটার নগত জুড়ি থাকা কালা আন্ধারটাকও দেখায়। ক্ষমতার নগত জুড়ি থাকা সমাজের এই মানষিগিলারঠে ঝায় ঝায় আশ্রয় খুজিচে তার তার কি আবস্থা হইচে সেটাও নেখকে দেখাইচে।

পেনকেটু গুরু বুলি মানে খইরুলক, সেই সুবাদে উঞাক ব্যবহার করে খইরুল। পানিয়া পাগলাহাটত চাহ্-র দোকান করে, আর কিছু জমি আছে, বিশেষ করি রাজগৈনের তিনবিঘা জমি। এই জমিটার কিছু অসুবিধা তৈয়ার করি দেওয়াতে পানিয়া ইমার এই দারহালি চক্রর সাহাইয্য চাইল। এই সুযুগক ব্যবহার করি ঘুরপথে ইমরা ক্যাং করি পানিয়ার জমি আত্মসাৎ করিল— বড়য় জুতসই করি নেখকে দেখাইচে। হেটার জন্যে কত ভালমন্দ কাণ্ডয় না করির নাগিল! পানিয়ার ভাগ্নি চিলকিশ্বরীর নগত পেনকেটুর বিয়াও, আর তার জন্যে যৌতক হিসাবে রাজগৈনের জমি— সেই জমি বছর বাদে উয়াক ঐ দার্হালি চক্রেরঠে বেচের নাইগবে। এই ব্যবস্থাটা মানি নিয়া আর এটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করিবে এমন কাথা কালী মাওয়ের থানের আগত খাড়া হয়া কিরা কাটি কওয়ার পাছতে উঞার গুরু খইরুল কাম শুরু করে আব শেষও করে। বিয়াও হয় পেনকেটুর নগত চিলকিশ্বরীর, এক বছর বাদে একেনা কইন্যা ছাওয়ার বাপও হয় পেনকেটু। আর সেলা আইসে খইরুল— জমিখান এলা রেজিষ্ট্রি দিবার নাগে কড়াল মত। কিন্তুক দুঃখ পায় উঞার মামাশ্বশুর। দিনত আন্ধার নামি আইসে।

পথম খণ্ডখান এইঠে শেষ। কিন্তুক যে ইঙ্গিত পাওয়া গেইল তাতে মনে হয়। গম্ফটা অনেক দূর যাবে। অনেক জটিলতা, সমাজের আরো অনেক গভীর পাঠ উঠি আসিবে বুলি আশা করা যায়। সমাজের গভীরত যে ধীরে ধীরে একটা খাওয়া-খাওয়ির চিত্র, দ্বন্দ্বের অবস্থা, ভালো-মন্দের একেঠেখুনা থাকা সদায় চলি আচে কাহিনীটা সেটায় যেনে দেখে দিয়া দিয়া আগে গেইচে। পরিশেষত কওয়া যায় এই উপন্যাস কয়টার ঘাটা ধরি যদি উপন্যাসের আরো ফসল ফলে তবে নিচ্চয় করি আশা করা যায় যে ভবিষ্যতত্ হামরা আরো ভাল ভাল রচনা পামু। সে সম্ভাবনা এই জনগোষ্ঠীর জীবনত আছে। খালি সেটায় না হয়, এই সাহিত্যও অইন্যপাখে জীবনটাক রূপ দেওয়াত আর অনুধাবন করাত সহায় করিবে। জীবন আর সাহিত্যর এইঠেখুনায় পরিপূরকতা।

খুঁজি নেওয়া— ভোগা (পহিলা সংখ্যা, কাতি ১৪২১) সম্পাদক: নিখিলেশ রায়। প্রকাশ: রাজবংশী ভাষা আকাদেমি।

Post a Comment

Previous Post Next Post