রাজবংশী ভাষা সাহিত্যর একেনা কোলাজ —অশোক রায়প্রধান

রাজবংশী ভাষা সাহিত্যর একেনা কোলাজ 
অশোক রায়প্রধান

১৪৭৭ শকাব্দ, আষাঢ় মাস, ইংরাজী মতে সালটা হবে ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দ। হামার কোচবিহার রাইজ্যের মহারাজা নরনারায়ণ অহম রাজাক একখান চিঠি নেখি পাঠালেক— ‘লেখনং কার্য্যঞ্চ! এথা আমার কুশল তোমার কুশল নিরন্তরে বাঞ্ছা করি। এখন তোমার আমার সন্তোষ সম্পাদক পত্রপত্রি গতায়ত হইলে উভয়ানুকূল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হইতে রহে। তোমার আমার কর্তব্যেসে বর্দ্ধিতাক পাই পুষ্পিত ফলিত হইবেক। আমরা সেই উদ্যোগতে আছি। তোমার এ গোঠ কর্ত্তব্য উচিৎ হয়। না কর তাক আপনে জান। অধিক কি লেখিম। সতানন্দ কর্ম্মী, রামেশ্বর শর্ম্মা, কালকেতু ও ধুমা সর্দ্দার, উদ্দত্ত চাউলিয়া, শ্যাম রাই ইমাক পাঠাইতেছি। তমরার মুখে সকল সমাচার বুঝিয়া চিতাপ বিদাই দিবা।


অপর উকীল সঙ্গে ঘুড়ি ২, ধনু ১, চেঙ্গামৎস্য ১ জোর, বালিচ ১, জকাই ১, সারি ৫ থান, এই সকল দিয়া পইছে। আরু সমাচার বুঝি কহি পাঠাবেক। তোমার অর্থে গোমচেং ১, ছিট ৫, ঘাগরি ১০, কৃষ্ণ চামর ২০, শুক্ল চামর ১০।

ইতি- শক ১৪৭৭ মাস আষাঢ়। রাজবংশী ভাষাত নেখা চিঠিখানে হয়া গেইলেক বাংলা ভাষা সাহিত্যর ইতিহাসের পথম গইদ্য রূপের দলিল। সুদায় বাংলা না হয় অহমিয়া ভাষা সাহিত্যরও গইদ্য রূপের পথম দলিল।

এই মতন হইলে বোধ হয় কওয়া যায় ভাগের মাও গঙ্গা নাই পায়। কিন্তুক সেই দিন শ্যাষ। আজি নয়া রূপে ভগীরথ হয়া গঙ্গাক ধরি আনির নাগিবে। মনত গাঁথিয়া থুবার নাগিবে এই পত্রখান হামার রাজবংশী ভাষা সাহিত্যর গইদ্য রূপের পথম দলিল।

অবশ্য এইলা কাথা হামার মানষিলা সগায় কমবেশী জানি। ফম কাহয় হামরা হারাই নাই। মুই খালি কণেক নাড়ে দিবার চাং। সেই বাদে রাজবংশী ভাষার মতন একখান ইতিহাস বিখ্যাত ভাষা নিয়া আলোচনার বাদে চলো কণেক কণেক করি পাছেয়া যাই ইতিহাসের ঘাটা ধরি।

১৮৭৬-৭৭ খ্রিস্টাব্দ, একঝন সাহেব, নাম জর্জ গ্রিয়ারসন, রংপুর, দিনাজপুর, কোচবিহার, কামরূপ ইত্যাদি জেলাগিলার গ্রামগঞ্জ ঘুরিয়া ফিরিয়া হামার দেশী মানযিগিলার গালাত কিছু গান, ছড়া, ছিল্কা শুনির পায়। ঐলা গান, ছড়া ছিল্কা নেখিয়া একঠে গোটো করিয়া “মানিক চান্দ রাজার গান” নাম দিয়া ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালত ছাপেয়া নিকলিবার ব্যবস্থা করে।

ছাপিয়া নিকলাইতেই সোরগোল পড়ি গেইসিল। আরো মেলা ভাষা সাহিত্যর জ্ঞানীগুণী মানষি হামার টারি বাড়িত আসিয়া আরো নয়া নয়া গান, কবিতা, ছড়া ছিল্কা চান্দেবার ধরিছিল। শ্যাষে চান্দে পায়া নয়া নয়া নাম ধরিয়া ছাপেয়া বই হয়া বিরাইসিল। এই মতনে একখান বই ১৯০৮ সালত রংপুর জেলার নীলফামারির স্যালাকার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য মহাশয় পরকাশ করিলেক কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হাতে, নাম ‘গোপীচন্দের গান’। অল্ফবিস্তর এইলা গানেরে নগদ আরো কিছু নয়া গান নাগে ঢাকা সাহিত্য পরিষৎ হাতে ছাপেয়া নিকলাইলেক ‘ময়নামতীর গান'। সংগ্রাহক নলিনীকান্ত ভট্টশালী ও বৈকুন্ঠনাথ দত্ত। ইয়ার পর আরও অনেক ইত্যাদি ইত্যাদি।

ময়নামতী - মানিক চান্দ গোপীচন্দ্রের সময়টাক ঐতিহাসিক ভাবে ধরির চাইলে হামাক দক্ষিণ ভারতের রাজা রাজেন্দ্র চোলের (১০২০ - ২৪ খ্রিস্টাব্দ) রাইজ্যর তিরুমালয় পাহাড়ের উপুরা নেখা শিলালিপি খান কণেক পড়িবার নাগিবে। লিপিখান পড়িয়া পাওয়া গেইচে যে বঙ্গদেশের রাজা গোবিন্দচন্দ্রক দক্ষিণের রাজা হারেয়া দেয়। অবশ্য ঢাকা সাহিত্য পরিষৎ হাতে নিকলা ‘ময়নামতীর গান' পড়িয়া হামরা উল্টাটায় জানির পারি। স্যালা কায় জিতিচে কায় হারিচে হুটা নিয়া আজি হামার কাউকাসাং করার বিষয় না হয়। একটা কথা খিপে গুরুত্ব দিয়া বুঝি থুবার নাগিবে যে, ইতিহাসের পাতত ধর্মীয়

(হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন-নাথ-আজিবিক-মুসলমান ইত্যাদি) পাল্টা-পাল্টির সমায় একটা খিপে বড় চাপ গেইছিল বঙ্গের উত্তরপাখের মানষিগিলার উপুরা দিয়া। ধর্মীয় চাপ, রাজনৈতিক চাপ, অর্থনৈতিক চাপ, সামাজিক চাপ, পারিবারিক চাপ, এত্তো চাপের ভিতিরাত পড়িয়াও কিন্তুক হারে যায় নাই, হারি যায় নাই। আপন ভাষা সংস্কৃতিক বাচেয়া থুইচে। কাচুয়া ছাওয়ার মতন বুকত ধরিয়া, বুকিনিত বান্ধিয়া বড় করিচে। একদিন দুইদিন না হয়, একমাস দুইমাস না হয়, বেশ কয়টা শতক ধরি এমনে করি আপন ভাষা-সংস্কৃতিক বত্তে থুইচে, বড় করিচে, হামারে দেশী রাজবংশী কিষাণ মানষিগিলা।

আর তার-এ ফলশ্রুতিত আজি মৌখিক সাহিত্য হিসাবে বাংলা ভাষা সাহিত্যর এক গুরুত্বপূর্ণ অইধ্যায় হয়া গেইচে মানিক চান্দ রাজার গান / ময়নামতীর গান / গোপীচন্দ্রের গান।

পাছত একেনা নেখা বইও ফির পাওয়া গেইচে, নাম গোরক্ষবিজয়। শ্রীযুক্ত আবদুল করিম মিয়া বইটার সম্পাদনা করিয়া কলিকাতা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থাকি প্রকাশ কৈচ্চে। উত্তরবঙ্গের রাজবংশী কিষাণ মানষিগিলার মুখে মুখে তৈয়ার হওয়া আর চলি আইসা এই মতন সাহিত্য সম্পদের রচনাকাল নিয়া শ্রীযুক্ত দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয় কইচে ‘ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনরুত্থানের পূববর্তী। — বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, ৩৪ পৃষ্ঠা।

১৮৯৮ সালের ২৬ শে জুলাই স্যার জর্জ গ্রিয়ারসন সাহেব একটা চিঠিত নেখিচে -'I think that in my former letter I have omitted to thank you for the correc tions which you have made to my edition of the Manik Chandra Rajar Gan which applied in 1887. Inow quite agree with you that its origin must be re ferred to Buddhist influence."

ভাষাচার্য্য শ্রীযুক্ত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় Gouda Banga Ramya Katha বইটাত উয়ার মেলা গবেষণা করা বিষয় তুলি ধরিচে। বইটার ৩৭ পৃষ্ঠাত নেখা আছে, যে ময়নামতীর গানগিলা বান্ধা হইছিল নবম-দশম খ্রিস্টাব্দ নাগাদ, ইয়ার পর বৌদ্ধ ধর্ম আর নাথ ধর্ম সমাজের যোগী গীদালগিলার মুখে মুখে ভারতবর্ষর নানাঠে ছড়েয়া যায়। "This is quite a romantic story, which may be partly historical but it became intimately connected, through the personality of Gopi Chand's mother Mayanamoti,... there stories appear to have originated in Bengal during the 9th-10th centuries, and then they spread over the whole of Aryan-speaking India, being taken up by both the Late Mahayana Buddhist teachers of Bengal and Eastern India in evolving their hagiology of Siddhas or miracle-working Cadets or masters' page 37, Gauda Banga Ramya Katha. ‘গৌড়বঙ্গ রম্য কথা’ বইটা ছাপেবার সমায় ভূমিকাত সেলাকার এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদক শ্রীযুক্ত ড. চন্দন রায়চৌধুরী মহাশয় নেখিছে— 'Bengal has a very rich heritage of oral literature. In fact, oral literature has served as a store house of ideas and themes for written literature, and it has succeeded in maintaining its rural base, distinc tiveness and freshness.'

ইয়ার পরেও কিছু ভাষা সাহিত্যর ‘পণ্ডিত মার্কা শিক্ষিত' মানষি আছে যেইলা উত্তরবঙ্গর রাজবংশী কিষাণ সমাজের মুখত পাওয়া সাহিত্য বুলি তাচ্ছিল্য করি গুরুত্ব দিবার না চায়। মুই মোর নেখা ‘ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে উত্তরবঙ্গ ও রাজবংশী' বইটাত দীঘল করি আলোচনা করিচুং। এইঠে ঐলা মানষির নাম নিয়া উমাক বড় বা ছোট কোনোটায় করির না চাং। হামার রাজবংশী কিষাণ মানষিগিলার মৌখিক সাহিত্য হামার রাজবংশী ভাষা সাহিত্যর সম্পদ। উয়াক হামরায় সসম্মানে মাথাত তুলি থুমু।

আর ঐ প্যাঁচকাটা ‘পণ্ডিত মার্কা শিক্ষিত’ মানষিলার তানে একেনা ছিল্কা মনত আসিছে ঐকিনায় শুনাং—

‘চাড়াল মানষির চাটিয়া বুদ্ধি,
তলত গামছা উপুরাত ধুতি।

মৌখিক সাহিত্য হাতে এলা কণেক নেখা সাহিত্যর উপুরা ঘুরাফিরা করি দেখা যাউক, রাজবংশী এলাকাত উত্তরবঙ্গর বুকের উপুরা কী কী পাওয়া যায়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন- ষ্ণবিজয়-কৃষ্ণ ধামালী ইত্যাদি ইত্যাদি, বঙ্গদেশের এক এক জায়গাগিলাত এক এক মতন নাম। তা নামে কি-বা আসি যায়—

‘কানা ছাওয়ার নাম হয় পদ্মলোচন
আর চখু মেলা ছাওয়া আন্ধালু।
যায় তায় থাকো যেইঠে সেইঠে
মুই মোরে সিতানত নিন্দানু।।”

নাম নিয়া ফাউকশালি কাচাল করি লাভ নাই। যায় যেইঠে যেমন পারে নাম হউক, ডাকাউক। কিন্তুক নিজের ঘাটা ঠিক করি থুবার নাগিবে। আং-সাং করা যাবার না হয়।

এই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রচনাকার হইলেক মালাধর বসু। মালাধর বসুর জন্ম বর্ধমান জেলার কুলীন নামের একখান গেরামত। আর কবি মালাধর বসুর প্রকাশ গৌড়ের রাজ সভাত। ১৪৭৩ হাতে ১৪৮০ খ্রীষ্টাব্দের ভিতিরাত এইখান নেখা। উত্তরবঙ্গর বুকত গৌড়ের রাজসভাত বসি এই কাব্যগ্রন্থখান রচনা, বুঝায় যায় কবির ভাষা আর ভাবনাত উত্তরবঙ্গর সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠীর (রাজবংশী) প্রভাব রবে। সঠিকভাবে কবার চাং রাজবংশী ভাষা আর সমাজের প্রভাব খিবে বেশি। এক কথায় কবার চালে কওয়া যায় যে হিটা হামারে রাজবংশী ভাষা সাহিত্যর সম্পদ।

মালাধর বসুর নিজের নেখা পুঁথিখান পাওয়া গেইচে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরত। ১৩২৫ বঙ্গাব্দে রংপুর হাতে নিকলা রংপুর সাহিত্য পত্রিকার পথম সংখ্যাত শ্রীযুক্ত যোগেশ চন্দ্র রায় নেখিছে,—‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুঁথি উত্তরবঙ্গ ঘুরিয়া বিষ্ণুপুরে আসিয়াছিল।'

রাজবংশী ভাষাটাক যেইলা ভাষার পণ্ডিত মানষিগিলা উপভাষা-বিভাষা তকমা নাগাইচে, উমরায় আপনে আপনে নিহাই নাগেয়া ফির রাজবংশী ভাষার পুঁথিখানক উমার ভাষার সম্পদ বুলি মানি নিচে। এই বিষয়ে কিছু ভাষাবিদের মন্তব্য তুলি ধরোং ১৩২৫ বঙ্গাব্দত রংপুর সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার তিন নং সংখ্যাত শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র রায় নেখিছে— 'কৃষ্ণকীর্তনের ভাষার আর একটি বিশেষত্ব এই যে উহাতে এরূপ অনেক শব্দ পাওয়া যায় যাহা সুদূর আসাম এবং উত্তরবঙ্গের গ্রাম্য ভাষায় চলিত আছে।'

কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান বিশিষ্ট ভাষাবিদ ড. নির্মল দাস মহাশয় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের নগদ উত্তরবঙ্গর রাজবংশী ভাষা আর সাহিত্যর উপযুক্ত প্রমাণ উল্লেখ করিয়া উমার ‘উত্তরবঙ্গর ভাষাপ্রসঙ্গ’ বইটাত নেখিচে, ‘একটি মাত্র দৃষ্টান্ত থেকেই অনুমান করা যায় যে সন্ধান করলে প্রাচীন ও মধ্য বাংলার অনেক প্রবচন ও ইডিয়ামই হয়তো উত্তরবঙ্গের লোকোক্তির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে।

শ্রীযুক্ত দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যর এক স্বনামধৈন্য মানষি উমার ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য' বইটার ১৩৪পৃষ্ঠাত নেখিছে—'সেই সময় হইতে আগত এক শ্রেণীর গান আমরা রঙ্গপুর, কুচবিহার, দিনাজপুর প্রভৃতি অঞ্চলে পাইতেছি – তাহার নাম কৃষ্ণ-ধামালী। ... প্রাচীন রাজবংশী জাতি ও যোগীরা বাঙ্গালাদেশের নানা স্থানে সেই প্রাচীন গীতিকাগুলি এখনও রক্ষা করিয়া আসিয়াছেন। ‘শুক্লা’ কৃষ্ণ-ধামালীকে সুন্দর করিয়া সাধুভাষায় প্রবর্তিত করিয়া কবিত্বমন্ডিত করিয়া চণ্ডীদাস কৃষ্ণকীর্তন লিখিয়াছিলেন। যদি কৃষ্ণ-কীর্ত্তন না পাইতাম তবে বুঝিতাম না গীত-গোবিন্দ ও কৃষ্ণ-ধামালীর পরেই হঠাৎ চণ্ডীদাসের অভ্যুদয় কি করিয়া হইয়াছিল।' শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের নগদ রাজবংশী ভাষার যে মিল আর তার অনুপ্রেরণা আর সূত্র হামারে ‘শুকুল কৃষ্ণ-ধামালী’ সেইটার এত বড় প্রমাণ আর সম্মান — চিন্তায় করা না যায়। রাজবংশী ভাষা আর সাহিত্য যে কত প্রাচীন, কত মূল্যবান সেইটায় আরো একবার প্রমাণ হয়া গেইল।

আরও একটা ভাষা সাহিত্যর ঐতিহাসিক দলিল বিষহরি গান-মনসামঙ্গল পদ্মাপুরাণ। বঙ্গ দেশের নানাঠে, নানান নামে প্রায় একশোঝন কবির নাম পাওয়া যায় যেইলা মানষি সাপের দেবীর নাম ধরি গান বান্ধিচে। সাপের পূজার চল হামরা বেশি করি দেখির পাই আদি জনগোষ্ঠীগিলার মাঝোতে। বনে-বাদারে, জলে-জঙ্গলে ঘুরা-ফিরা করা মানষিলার সাপের নগদ ঘর করা, আরো ফির সাপের নগদ নিহাই। ঐ তানে সাপের পূজার বহরটা কণেক বেশি দীঘল। হাতাস হাতে ভালোবাসা আর সেইঠে হাতে ভক্তি। উত্তরবঙ্গটাও হামার জল-জঙ্গলের দ্যাশ। সাপের উপদ্রপ-অইত্যাচার, ভাব-ভালোবাসা, তাগিরে কণেক বেশি। হামার দেশি রাজবংশী মানষিগিলার বাড়িত বিষহরির পূজার চলন প্রাচীনকাল হাতে চলি আসির ধরিচে। প্রায় সগারে বাড়ির পুব মুখে বা উত্তর মুখে বা উত্তর-পুব মুখে বিষহরির থান দেখিবার পাওয়া যায়। পাইসা-কড়ি থাকিলে থানের বদলে ফির মন্দিরেরও দেখা মিলে। পত্তিদিন সাকালে ফুল জল দিয়া পূজা দেওয়া খাবে। আর শন-ভাদোর মাসের একটা দিন দেখিয়া অধিকারীক ধরিয়া পূজা হবে। আরো ফির বাড়ির কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান হইলে সেই সময় আধিকারীক ডাকেয়া পথমে বিষহরিক পূজা দিবার নাগিবে। অবস্থা ভালো হইলে বিয়াও, অন্নপসন, কাম ইত্যাদির সমায় বিষহরির গান ফির এলাও হয়। এই মতন একখান প্রাচীন বিষহরির পালা গান ড. আশুতোষ দাস এবং শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য্যর সম্পাদনায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হাতে ‘কবি জগজ্জীবন বিরচিত মনসামঙ্গল' নাম থুইয়া ১৯৬০ সালে প্রকাশ হইছে। বইটার নাম পড়িয়ায় বুঝিবার পাইছেন মূল রচনাকার তথা সংগ্রহকারী কবি জগজ্জীবন। কবি হিসাবে বা গিদাল হিসাবে উত্তরবঙ্গত উমার সময়ে খুবে নামডাকওয়ালা মানষি।

উত্তরবঙ্গর কবি, আরো ফির উত্তরবঙ্গর রাজবংশী ভাষাত সাহিত্য রচনা, বুঝায় যাছে, রাজবংশী লোক জীবনের নানান পাখের ছাপ ফুটি উঠিবে উমার সাহিত্যর ভাব আর ভাবেনাত্। আর হইছেকও তেমনটায়। একটা ছড়াত হামরা পাছি (পৃষ্ঠা - ২৯০)

‘মাঝিয়াত নাই মাটি
চতুর্দ্দিগে নাই চাটি
বাহিরে না পড়ে তার পানি।।
ঘরে আছে সর্ব্বস্ব ভাঙ্গ আছে দলা দশ
মৎসের সুকটা দলা (সিদল) সাত।।
এই মতনে আর একখান ছড়াত পোয়া যায়–
গোদার ঘর / হৈতে অনেক সর্ব্বস
ভাঙ্গ এক ভাণ্ডার / সুকটা দলা (সিদল) দশ।

মাঝিয়া, চাটি-বেড়া, পানি এমন শব্দগিলা অনেক মানষির নেখাতে পাওয়া যায়, কিন্তুক উত্তরবঙ্গের কোচ, মেচ, রাভা, রাজবংশী, বোড়ো মানষিগিলার আন্দোন ঘরের সুকটা সিদোলের মতন এইলা খাইদ্য খাবারের কথা কওয়ায় জগজ্জীবনের নাখাম কবির গান আর ছড়া যে খিবে জনপ্রিয় হয়া গেইছিল সেইটা হামরা আজিও সগায় বুঝিবার পাই।

‘উচ্চারণে উত্তরবঙ্গের উপভাষার লক্ষণাশ্রয়ী তৎসম শব্দসমূহের বৈশিষ্ট্য স্মরণ করিয়া আধুনিক সংশুদ্ধ রূপ দেওয়া আবশ্যক মনে করি নাই। তদ্ভব শব্দগুলির বানানও যথাদৃষ্ট রাখিয়াছি।'

কাথাগিলা মোর না হয়, মনসামঙ্গল বইটা সম্পাদনা করিবার সমায় ড. আশুতোষ দাস বইটার ভূমিকাত এই মতন নেখি থুইচে।

দুই মতন বিষহরি পূজার চলন রাজবংশী জনগোষ্ঠীর মানযিগিলার বাড়িত দেখির পাওয়া যায়। শুকুল বিষহরি আর গীদালি বিষহরি পূজা। বিষহরির থানত শন-ভাদোরের শুষ্কা পক্ষত পূজা হয়। অধিকারীর মন্ত্র কওয়ার ভিতিরা দিয়া হয় পূজা পাঠ, উয়াক কয় শুকুল বিষহরি পূজা আর এই যেমন বিয়া-শাদি, মুখত ভাত, কাম-কিরিয়া ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আগত বিষহরি গান নাগাইলে, পালাগানের গীদালি বা গায়েন গানের আগত একখান পূজা দেয় বিষহরির থানোেত, তাক কয় গীদালি বিষহরি পূজা। সেই গীদালিগিলাক দণ্ডবৎ জানেয়া এক অসাধারণ বক্তব্য ভূমিকাত নেখা আছে, ‘একদিকে নতুন শব্দ সৃজন, অন্যদিকে বহু আঞ্চলিক (উত্তরবঙ্গীয়) শব্দের কাব্যাবয়বে স্থান সন্নিবেশ তাহার শাব্দিক কবিত্ব ও বাঙ্গালীমনন সুলভ অভিনব সৃষ্টিক্ষম প্রতিভায় ভাষাপথ খননের প্রতীতি - প্রচুর শক্তি খ্যাপন করে। তথাকথিত মাইকেলী ক্রিয়াপদ বাংলা ভাষার যে সামর্থ্য-বিদ্রুত গতিপথের সন্ধান দিয়া বাংলা মহাকাব্যসিন্ধুর তরঙ্গ গর্জন শুনাইয়াছে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে বহুপূর্ব হইতেই উহার ক্ষেত্র নির্মিতির যে গোপন সৃষ্টি প্রয়াসী পথ-পত্তন কার্য চলিতেছিল তাহার ধ্রুব পরিচয় তন্ত্রবিভূতি এবং রামদেবের ন্যায় জগজ্জীবনের কাব্যেও রহিয়াছে।'

সূত্র– ভূমিকা, কবি জগজ্জীবন বিরচিত মনসা মঙ্গল। অর্থাৎ ঊনবিংশ শতকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের যে ধারা বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যক একটা বিশেষ উচাত নিয়া গেইচে বুলিয়া হামরা জানি ঐ ধারাটা চলি আসির ধরিচে বেশ কতক শতক আগে হাতে আর তার চর্চার জায়গা-জমিন হইছে হামারে উত্তরবঙ্গ আর রাজবংশী ভাষা। এলা বুঝেন, ইতিহাসের কোলাত রাজবংশী কিষাণ মানষিগিলা কিষি কাম কাজের ফাকে-ফুকে সাহিত্য ভাব আর ভাবেনার চর্চাক কতটা উচাত নিয়া গেইলে ভাষা সাহিত্যর পণ্ডিতগিলা এই মতন গৌরবের কথা নেখে।

জগজ্জীবনের মনসামঙ্গল হামার রাজবংশী ভাষা সাহিত্যর দলিল। অইন্য সর্পদেবীর গানগিলাও হামার উত্তরবঙ্গর রাজবংশী ভাষা আর ভাবনা হাতে মুক্ত হবার পারে নাই। এই বিষয়ে মোর চর্চার শ্যাষে যে নেখাটা নেখিচুং সেইটা কিছুদিনের ভিতিরাতে চলি আসিবে। এইঠেকার সাপের দেবীর বিষয়ে গান আর পূজার ক্ষেত্রত হামার বিষহরি হইলেক পথ প্রদর্শক।

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যর নাম হামরা মোটামুটি সগায় জানি। এই চণ্ডীমঙ্গলের ভাষাত হামরা রাজবংশী ভাষার ছাপ খিপে খুজিয়া পাই। কাহিনীর মাঝত পাওয়া যায় রাজবংশী জনগোষ্ঠীর ছাপ। আর তারে তানে পণ্ডিত মানষিগিলা ইয়াক রাজবংশী সাহিত্য বুলি চর্চা করে। শ্রীযুক্ত সুকুমার সেন মহাশয় উমার ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস' বইটাত নেখিচে ‘মানিক দত্তের কাব্যের পুঁথি সব উত্তরবঙ্গের’ (পৃষ্ঠা ৩৬০)। এইঠে কিনা কণেক জানেয়া থোং যে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আদি কবি মানিক দত্ত।

এমন স্বীকৃতি ইতিহাসের কোলাত রাজবংশী কিষান মানযিগিলার ভাষা-সাহিত্য সংস্কৃতি বোধ আর চর্চার ভিতি শ্রদ্ধায় বাড়ে দেয়। হামার ভাষা সাহিত্যর ইতিহাসের খোঁজ খবর নিবার চাইলে একটা অধ্যায় ভাল করি খুঁজি দেখিবার নাগিবে সেইটা হইচে ‘রংপুর সাহিত্য পরিষৎ', আর ঐ পরিষদের পত্রিকা। ১১ বৈশাখ ১৩১২ বাংলা সাল হাতে ১৩৪৫ সাল পর্যন্ত অনেকগিলা পুঁথি সংগ্রহ করিয়া তাক ছাপেয়া নিকলিবার ব্যবস্থা করিছিল, মেলা গান, কবিতা, ছিল্কা ছাপেয়া নিকলাইচে যেইলা হামার রাজবংশী ভাষার অমূল্য দলিল। সবার চায়া বড় বিষয় ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার বহু পরিশ্রমে খুঁজি-পাওয়া গোবিন্দ মিশ্রর গীতা। যেইটা সপ্তদশ শতাব্দীর পথম ভাগেতে অসমীয়া বৈষ্ণব গুরু দামোদর দেবের ইচ্ছাতে উমরা অনুবাদ করিছিল। ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার আরো অনেকগিলা খুঁজি পাওয়া সাহিত্য চর্চার খোঁজ হামরা ঐঠে পাছি। যেমন, ‘রংপুরের রূপকথা’, ‘জগন্নাথী বিলাই’, ‘কথা ও ছিল্কা’ ইত্যাদি।

রংপুরের রূপকথা— পৃষ্ঠা ৩২-৩৭ —সংখ্যা ১ বছর / ভাগ-৩

জগন্নাথী বিলাই— পৃষ্ঠা ৯২-৯৬ —সংখ্যা ২ বছর / ভাগ- ৫

কথা ও ছিল্কা— পৃষ্ঠা ৯৮-১০২ সংখ্যা ২ বছর / ভাগ-৬

কথা ও ছিল্কা— পৃষ্ঠা ৮৫-৮৮ —সংখ্যা ২ বছর / ভাগ-২

গোবিন্দ মিশ্রের গীতা— পৃষ্ঠা ১-৭ —সংখ্যা ১ বছর / ভাগ-২

গোবিন্দ মিশ্রের গীতা— পৃষ্ঠা ৪৯-৬৬ —সংখ্যা ২ বছর / ভাগ-২

গোবিন্দ মিশ্রের গীতা — পৃষ্ঠা ১২০-১৩৩ —সংখ্যা ৩ বছর / ভাগ-২

রংপুর সাহিত্য পরিষদের সোনার খনির খোঁজ নিবার গেইলে ফির হুস করি হবে না। বাংলাদেশের অনুমতি নিয়া কাম করিবার নাগিবে। কিন্তুক হাতের গোড়াতে হামার এইটে এই মতনে একখান সোনার খনি আছে ‘কোচবিহার স্টেট লাইব্রেরী'। কোচবিহার রাজ সভাত কম করি ২৩০ টার মতন বই অনুবাদ হইছিল। হাতত নেখা ঐ বইগিলার কয়টা প্রায় পাঁচ শও বছরের আগিলা। বাংলা আর অসমিয়া সাহিত্যর পণ্ডিতগিলা অনুবাদ সাহিত্যর ভাণ্ডার টাক ভাগ করি নিচে। কিন্তুক সেই সমায়ের অসমিয়া আর বাংলা ভাষা যে রাজবংশী ভাষার কোলাত-পিঠিৎ বড় হইচে তারও গবেষণার মূল্যবান উপাদান ঘুসিয়া আছে ঐ অনুবাদ সাহিত্যর পাতত।

চলো, আরও কণেক পাছেয়া যাই। বাংলা-অসমিয়া-উড়িয়া ভাষা সাহিত্যর পথম নিদর্শন ‘চর্যাপদ'। হিটাও হামারে রাজবংশী মানষিলারঠে পথম শুনিবার পাইছে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশাই। আজিকার হিসাবে নেপালের পুব পাখে ভদ্রপুর আর ঝাপা জেলা, বিহারের পুব পাখে পূর্ণিয়া জেলা, আর ইতিহাসের পাতত এইলা জায়গা জমিন এলায় নেপাল রাজারঠে তো সেলায় কামতাপুর রাজারঠে আর ফির এলায় কামতাপুর রাজার অধীন তো সেলায় নেপাল রাজার অধীন। কিন্তুক একটা কথার ফির অদল বদল হয় নাই। সেইটা হইছে এই এলাকার মানষি(প্রজা)গিলা রাজবংশী। শাস্ত্রীমশাই ঘুরি বেরেবার তানে এইলা জাগাত আসিয়া রাজবংশী মানষিলার টারি-বাড়িত মাইয়া ছাওয়ালার গালাত কিছু গান-ছড়া-ছিল্কা শুনির পাইছে। বাংলা ভাষা বা অসমিয়া ভাষা না হইলে উড়িয়া ভাষার আলোয় (বুদ্ধি দিয়া) এইলা গান-ছড়া-ছিল্কা কণেক বুঝা গেইচে। ঐলা ভাষার 'আলো' ফেলাইলে কণেক বুঝা যায়, কণেক বুঝা না যায়। সেই তানে ভাষাটার নাম হয়া গেইল 'সান্ধ্য' ভাষা। সইদ্ধার সমায় যেমন হয়— কণেক দেখা যায় কণেক দেখা না যায়। কণেক পড়া যায় কণেক পড়া না যায়। কণেক বুঝা যায়, কণেক বুঝা না যায়।

শাস্ত্রীমশাই বহু পরিশ্রমে নেপালের রাজ লাইব্রেরী হাতে এই গান-ছড়া ছিত্তাগিলার লিখিত রূপ জোগাড় করিয়া ১৩২৩ বঙ্গাব্দত কলিকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ হাতে ‘বৌদ্ধ গান ও দোঁহা' নামে ছাপিয়া নিকলায়। ইয়ার পর মহম্মদ শহীদুল্লাহ মহাশয় একখান বই বির করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হাতে, নাম “Buddhist Mystic Songs"। তারপাছত আরও অনেক বই নিকলায়। কাহো নাম থুইচে চর্যাচর্য বিনিশ্চয়, কাহো আশ্চর্য চর্যাশ্চয়, কাহো চর্যাগীতি, কাহো চর্যাপদ ইত্যাদি ইত্যাদি।

ভাষা বিজ্ঞানের গবেষণাত ধরা পড়ে যে, এইলা গান-ছড়া-ছিল্কা দশম থাকি দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দের রচনা। বাংলা-অসমিয়া-উড়িয়া ভাষাগিলা যেলা কাচুয়া ছাওয়ার মতন হাক্কুরা পাড়িছে সেই সমায় এইলা গান-ছড়া-ছিলা তৈয়ার হইছিল। এইলা বাংলা-অসমিয়া-উড়িয়া ভাষা সাহিত্যর পথম নিদর্শন।

একটা কথা এইঠেকিনা কয়া থুবার চাং, ধরে দিবার চাং চর্যাপদগিলা পাওয়া গেইচে রাজবংশী অধ্যুসিত এলাকাত, রাজবংশী মানষিলার টারিবাড়িত, রাজবংশী বেটিছাওয়াগিলার গালাত গান-ছড়া-ছিল্কা হিসাবে। এইটা হামার রাজবংশী ভাষার ইতিহাসের পথম নিদর্শন, আজি পর্যন্ত।

‘আজি পর্য্যন্ত’ কথাটা কেনে নেখিলুং? সামান্য কয়েক বছর আগতে এই হামারে রাজবংশী মানষিগিলার টারিবাড়ি ঘুরিয়া শ্রীযুক্ত রাহুল সাংকৃত্যায়ন মহাশয় চান্দে পাইচে কবি বিনয়শ্রীর নেখা ১৩টা নয়া চর্যাপদ, কবি সরুঅ-র নেখা ২টা নয়া চর্যাপদ আর কবি অবধুর নেখা ১টা পদ। আরও ফির লুইপাদ আর কাহ্নপাদের ১টা করি গান। বুঝিবার নাগিবে সঠিকভাবে কান পাতিলে, চান্দে বেরাইলে আজিও ফির বহু কিছুর সন্ধান পাওয়া যাইবে।

আজি সুদায় মুখত কইলে হবার না হয়। নেখি থুবার নাগিবে। আর নেখিবার বাদে চাই লিপি। এই লিপির ইতিহাস পড়িবার গেইলেও ফির উত্তরবঙ্গ তথা রাজবংশী ইতিহাস চলি আসিবে। ড. দীনেশচন্দ্র সেন মশাই উমার ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য' বইটার আট পৃষ্ঠাত নেখিচে খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর নেপালী অক্ষরের সহিত সমসাময়িক বঙ্গাক্ষরের বিশেষ সাদৃশ্য বর্তমান।'’ মনত থুবার নাগিবে চর্যাপদগিলার ভাষাত মেলা রাজবংশী শব্দ, রাজবংশী সমাজের কথা পাওয়া গেইচে রাজবংশী মানষিলার টারিবাড়িত। বাংলা লিপি যা আজিকার অসমিয়া, মণিপুরী, অলচিকি এবং অবশ্যয় বাংলা ভাষার অক্ষর হিসাবে চলির ধরিচে তারে তেপুরানিকালের লিপির নিদর্শন হামরা পাছি নেপালের রাজ লাইব্রেরীত পাওয়া বোধি চর্যাবতারে আর গৌড়ত বসি নেখা শ্রী কৃষ্ণকীর্তনের প্রাচীন পুথিত।

বঙ্গদেশের ভিতিরাত আগিলাতম যে কয়কান তাম্রলিপি-শিলালিপি পাওয়া গেইচে সেইলা তাগিরলায় উত্তরবঙ্গর বুকত খুঁজি পাওয়া। একটা নাটোরের ঝিনাইদহ গ্রামোত (888-৪৪৮ খ্রিস্টাব্দ), আর একটা দিনাজপুর জেলার দামোদরপুরোত পাওয়া, অন্য আর একটা মহাস্থানগড়ত পাওয়া গেইচে। সমায়ের বিচারত মহাস্থানগড়ের লিপি দ্বিতীয় বা তৃতীয় খ্রীষ্টপূর্ব আর লিপি হিসাবে পূর্ব-প্রাকৃত লিপি। ড. সুকুমার সেন মশাই উমার বিখ্যাত এই বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস বইটাত দশ পৃষ্ঠাত নেখিছে ‘আজ অবধি বাঙ্গালা দেশে যে সকল প্রত্নলিপি পাওয়া গিয়াছে তাহার মধ্যে প্রাচীনতম হইতেছে বগুড়া জেলায় পুণ্ড্র (মহাস্থান গড়ে) প্রাপ্ত পূর্ব্বী প্রাকৃতে রচিত লিপি।' কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হাতে নিকলা ‘বঙ্গলিপির উৎপত্তি' বইটাত ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এলাহাবাদ স্তম্ভলিপির কথা তুলি ধরি উল্লেখ করিচে যে ওইটা লিপিত বাংলা লিপির প্রাচীন ধারা দেখির পাওয়া যায়। এইঠে মনে করি দিবার চাং যে, ঐ লিপিত হামার কামতাপুর রাজ্যর নাম ‘কতৃপুর' হিসাবে খুঁজি পাই। প্রত্নতাত্ত্বিক বুহলর সাহেব নেখিচে যে, খ্রীষ্ট্রীয় দশম-একাদশ শতাব্দী নাগাদ পূর্ব ভারতের নেপালী ভাষা নাগা এলাকাত নাগরী লিপি হাতে বাংলা লিপি তৈয়ার শুরু হয় । নাগরী লিপি হাতে বাংলা লিপি, পালি হাতে প্রাকৃত পূর্ব-প্রাকৃত লিপি, প্রাচীন/আগিলা ব্রাহ্মী লিপি, ইত্যাদি এই মতন নানান লিপির কোলাজ গড়ালে যে নামখান ফুটি উঠিবে সেইটা উত্তরবঙ্গর রাজবংশী। হামরা সগায় দেখিছি, শুনেছি কণেক কণেক ফির বুঝিছি যে, হামার উত্তরবঙ্গর সামাজিক, অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক অবস্থা আর অবস্থান পাল্টে যাবার ধরিচে। চক্ষুর আগতে অনেক জিনিস হারে যাবার ধরিচে দেখিবার পাছি কিন্তুক কিছুই করিবার পাই না। তাও তারে ভিতিরাত খিবে আনন্দের কথা শ্যাষ-মেষ রাজবংশী ভাষা আকাদেমি গঠন হইচে। better late than never. বহুদিনের রাজবংশী দেশি মানষিগিলার মনের ইচ্ছাটাক স-সম্মানে প্রতিষ্ঠা দিচে বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, উমাক আন্তরিক ধন্যবাদ। চাপ কিন্তুক বাড়ি গেইলেক। মেলা কাম। যেইলা মানষি আকাদেমির ভিতিরাত আছেন, আকাদেমির নানান কাম কাজে ঝাল্লি পড়িবার নাগিবে। সময় মেলা চলি গেইচে, আর ছাড়া না যায়, নানানঠে নানান জিনিস নুকি আছে, খুঁজিয়া নিকলি আনিবার নাগিবে। নয়া আর পুরান মিশিয়া একটা নৌতন সাহিত্য শিল্পভাণ্ডার তৈয়ার হউক। নেখা হউক রাজবংশী জনগুষ্ঠীর আর উয়ার ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাস। হামরা যেইলা মানষি বাহেরাত আছি, মোর মতন যেইলা মানষি কামে কাজে কণেক দূরত আছি, হামরাও মেলা আশাত বুক বান্দি আছি। কান খাড়া করি আছি নয়া কিছু ভাল শুনিবার বাদে, চখুত ছানি পড়িবার না দেই নয়া ভাল কেছু দেখিবার তানে।

খুঁজি নেওয়া— 
ভোগা (পহিলা সংখ্যা, কাতি ১৪২১)
সম্পাদক: নিখিলেশ রায়।
প্রকাশ: রাজবংশী ভাষা আকাদেমি।

Post a Comment

Previous Post Next Post