কানার পাও খালােৎ | ভবেন্দ্রনাথ রায়

কানার পাও খালােৎ
ভবেন্দ্রনাথ রায়

বাড়িত আছেন না নাই ?পােষ্টপিসের পিয়নটা হরিকান্তর খলতৎ খাড়া হয়া চ্যাচেয়া ডেকাছে। কমরটাহ্যাকেরে হ্যাকেরে ধীরে ধীরে শুল্কিত বিরিয়া কায় হুনাখান করি ডেকাছে, দেখিবারধরিলেক হরিকান্ত। পিয়নটা উয়াক দেখিতেকালে কইল, তােমার একখান।রেজিস্টারী চিঠি আছে এইঠেকেনায়। সই করিয়া চিঠিখান ন্যাও। সই করিবারপারেন তাে? না টিপসই করিবেন?—“চিটিখান কোষ্ঠে থাকি আসিছে পিয়নবাবু? ভয় ভয় করি মনত কণেক সাহস করি কথালা পুছিলেক হরিকা।—“রাজস্থান থাকি আসিচে। রাজস্থানত তােমার কাহাে আছে নাকি?—‘মাের বেটা আজস্থানত আছে পিয়নবাবু। তুলার কলত কাম করে’– চট করি কথালা কয়া‘কোষ্ঠেকে সই করিবার নাগিবে কও দেখি’ কয়া কলমটার তানে হাত বাড়ালেক।--‘সই করিবার পারেন তাহলে? হরিকান্তর পাখে দেখিতে দেখিতে পিয়ন নারায়ণ দাস কলমটা উয়ার হাতত দিয়া খাতাখান আগেয়া দিলেক। হরিকান্ত ধিন্দি ধিন্দি দেখিয়া হাত কাপাইতে কাপাইতে উয়ার ঠ্যাংগার ঠ্যাং-এর নাখান তারাং-ব্যারাং করি কুলােগত্তিকে সই করি দিয়া চিটিখান ধরি বাড়ি ঢুকিয়া খাম থাকি নিকিলিয়া বানান করি করি পড়িবার ধরিলেক। পড়িতে পড়িতে হরিকার বুক শেলনাগি গেইল।অনেকখান বাদে আউঞি উঠিয়া উয়ার বনুষক কাউসি ড্যাকেবার ধল্লেক‘ঘন্নি চটকরি শুনি যা, হামার কপালােত কুড়ালের চোট পড়িচে আসি দেখেক। হরিকান্তর বনুষ ন্যাকেশ্বরী চুয়া গেইচে জল আনিবার। সােয়ামীর ঐ নাখান ডেক শুনিয়া জলের বান্টিংটা ধরিয়া কাউসি হাটি আসিয়া হরিকার বগলত খাড়া হয় পুছিবার ধল্লেক ধারায় ধারায় আরও তােমার কী হইল?-হ্যার দ্যাখ দেখি হামার কপাল অগুন নাগি গেইচে। ঘর মইধ্যে একেনা বেটা বিদেশ খাটিবার যায়া। কত বাধা করিলুংনা নাগে রে বাপইনা নাগে হামার দ্যাশত ভাল। দ্যাশ ঘুরিয়া বারাে, ঘরত বসি তেরাে। এলা কী হইল তুই যে কেকংর খাবাে আর হামাকে বা বুড়ালি বসত কী খােয়াবাে কয়া ডুকুরি ডুকুরি কান্দিবার ধল্লেক। ন্যাকেশ্বরী আর ঝিৎ থাকিবার পারিলেক না। ঝিঙ্গিরি উঠিয়া কবার ধরিলেক, কি যে হইল পষ্টাপষ্টি কইলে হয়। খালি বাপইটা বাপইটা কয়া কান্দির ধরিছে। কী হইচে কবেন তাে?’ হরিকান্ত কণেক সামােল দিয়া কইল, হ্যার দ্যাখদেখি হামার নবকান্তটার কী হইছে’; কয়া কণেক ঢােক গিলিয়া কবার ধল্লেক, নাত্তিত কাম করিতেকরিতে কলত একটা ঠ্যাং ঢুকি গেইচে। টারির দিনেশের বেটা যােগেশ আরও এত্তিকার চেংরালা দেখিয়া ধরাধরি করিয়া হাসপিতাল নিয়া গেইসে। ডাক্তারবাবু ঠ্যাংটাক হাটুয়ার নিচাত কাটি দিছে। কলের মালিক বােলে তামান খরচা দিছে। এলাবােলে ভালে আছে। ক্যামন বােলে ঠ্যাং পাওয়া যায় কিনিতে ঐটা ঠ্যাং কিনিয়া জোড়া নাগে দিবে। শ্যাষত নেখিচে অনেকলা টাকা বােলে পাওয়া যাবে।কথালা শুনিতে শুনিতে ন্যাকেশ্বরী মাটিত গড়াগড়ি দিয়া কান্দিবার ধরিলেক আর কপাল চাপড়াইতে চাপড়াইতে কবার ধরিলেক ভগবান এলা হামার কি গতি হবে। উমার কাণ্ড কীত্তিলা দেখিয়া হিবাড়ি হুবাড়ির মানষিলা দৌড়াদৌড়ি করি আসিয়া কী হইল কী হইল’ পুছিবার ধরিলেক ঐ টারিরএ শ্যামচরণ বুড়া, বয়স না হইলেও আশির অগলবগল হবে তামানে শুনিয়া কইল, চেংরাটা বৈদেশ যাবারে না চায় তাও তােমা জোর করি পেঠালেন। রাতারাতি কি বড়লােক হওয়া যায় ?তামান সেই ঝনের নীলা। এলা কী কাণ্ড হইল দ্যাখেক দেখি। বৈদ্যাশৎ কায়-বা খােজ করে দ্যাখেয়বা কায়... দ্যাশতে মানষির আকাল। এইমতন করি সগায় মিলি নানান কথা কয়াবুলি আস্তে আস্তে বাড়ির পাকে ঘাটা ধরিলেক। হরিকান্তর ঘরও দোনাে মাইয়া-ভাতারে কান্দি কাটি ঠুসমুস করি বাড়ির ভিতিরাৎ গেইল। ওদিকেনা যােগেশ দিনেনাত্তি নাগার হাসপাতাল যায়া নবকান্তর কেরামতি করিবার ধরিল। রাজস্থানত যাবার সময় নবকান্তর বাপ-মাও উমার বেটাটাক বিদ্যাশৎ নজর দিবার তানে।যােগেশক খিপ কাউলাইচে। যােগেশ কথাটা ফম থুইচে। ভালভাল ঔষধপাতি চলির ধরিচে বাদে।কাটাখান দিনদিন আটেবার ধরিল। ডাক্তরলা কইছে তাও বলে মাসখানিক নাগির পায়। যেলা করি নবকান্ত ঠ্যাংটার ভিত্তি দ্যাখে সেলা কবি উমুলি উমুলি কান্দি উঠে আর ভাল হয়া মুই কেংকরি কাজকামাই করিম, আরও কত কি! উয়ার চিনাজানা সগায় উয়াক নানান পাকে থাতিপি দিবার ধরিল।কিন্তুক তাহাে উয়ার মন ভাও মানে না। কুনাে কুনাে সমায় বাপ-মাওক দেখিবার তানে মনটা ছটফটায়।যােগেশ নানানখান কথা কয়া ইয়াক থাতিপি দিয়া ঘােয়।।একদিন কাটাখান বােয়াপাখলা করির সময় ওইঠেকার ডাক্তারবাবু নবকান্তক পুছিচে ‘তাের বাড়িকোষ্ঠে ? বাড়িৎ কায় কায় আছে? ক্যানে এইমন আলনবসতে এঠেকোনা আসিলাে। এলা থাকি তুইআগের নাখান আর হাটাচলা করির পারিব না।’ ডাক্তারের কথা শুনিয়া নবকান্ত কান্দিতে কান্দিতে কইচে‘বাড়ী মাের পশ্চিমবাংলার জলপাইগুড়িজেলার গৌডগ্ৰামত। বাড়ীত মাের বাপ মাও আছে। মুই বাপের একেনায় বেটা। হামার চৌদ্দপুরুষথাকি ঠেকনায় আছি। মাের ঠাকদ্দার আমলে জমিজাগা ভালে আছিল। আগিলা মানষি আছিল সাদাভােদা আর আলসিয়া। কাজকামাই বােলে কণেক কম করিচে। ইনারবাদে আজি কণেক কালিকণেক করিয়া জমিজাগা বেচাইতে বেচাইতে ফুতুরফাট হয়া পরে সেলা মানষির বাড়িত কাম করিখাইছিল। ঠাকুদ্দা মরি যায়া বাপের হালখান বেটা পাইল। মাের বাপও ঐ নাখান করি পড়ার বাড়ি কাম।করিয়া সংসার চলাইচে। কুনাে কুনােদিন এমন অভাব, হুলা কথা ফম করিলে চখুগিলা এলাও ভিজিয়া যায়।।ডাক্তোরলা পুছ করিচে –‘অত্তিনা কুনাে ফেকটারী টেকটারী নাই?'।—কোষ্ঠে আরও ফেকটারি, একটা মিল পাইতে ধাউ! হামার দ্যাশত কুনয় নাই।ডাক্তোরলা ঠস নাগি শুনিচে উয়ার কথা!... এই নাখান কষ্ট করি নইতে নইতে আর সবার না পারিয়া শ্যাষম্যাশ বুড়া বাপমাওক দ্যাশতথুইয়া দ্যাশের ময়হা পাশুরিয়া দুইপাইসা কামাই করির তানে যােগেশদার নগ ধরি নাজস্থান আসিয়াতুলার মিলত সােন্দালুং। হেটেকেনা কয়দিনতে কাজকামাই ভালে হবার ধল্লেক। মনটা কইলএইমন কামাই কাজ হইলে কয়কেনা বছর বিদ্যাশ খাটিলে দ্যাশত বাপ-মাক আর আগের নাখান কষ্ট করির নাগিবে না। কিন্তু কী করিবেন ডাক্তোরবাবু, কানার পাও খালােত-এ পড়ে। কপালত নাই ঘি ঠকঠকাইলে হবে কী । কপালােৎ যেইটা নয় ঐটায় হয়। কথাতে না কয় “যেই দুখ সেই দুখনিরলে না ভিজে বুক’ এলা যে মাের কপালৎ কী হবে কবারে না পাং।নবকান্তের কথালা শুনিয়া ডাক্তার পুচ করে, “আচ্ছা তােমার দ্যাশত সরকারি কুনাে সুযােগ সুবিধা নাই ? যায় ঐ নাখান কাজকামাই করি খাবার না পায় তার তানে?”নবকান্ত কথাটা শুনিয়া কয়, “শুনা তাে যায় হামারলার তানে সুযােগ সুবিধা বােলে আছে কিন্তুক হুলা তাে ঐ ঘরে ঘরে ঘর খায়। যার মামা কাকা দ্যাশের নেতা, অফিসের বাবু ঐলা সুযােগ সুবিধাতাে উমারলার-এ তানে। হামাব আরও কী?অবশ্যাষকালে ডাক্তোর কয়, ‘বাউ কপালােৎ যেইটা আছিল সেইটা তাে হয়ায় গেইচে দুঃখ করি কীকরিবাে। এইঠেকেনায় বীমা কোম্পানীরঠে থাকি হাজার পঞ্চাশেক টাকা পাবু। হুনঠাউরি খরচ নাকরিয়া ওই টাকা দিয়া কুনােখান করি খাবার পারিবাে আর কি। কলের মালিক ঠ্যাং নাগে দিলে বাড়িচলি যাইস। মাসখানিক হাসপিতালত নয়া নবকান্ত ভাল হয়া গেইল। কলের মালিক উয়াক কোয়াটারােত ধরি আসিল। ঠ্যাং নাগেবার আল দিয়া একখান কাগজত একটা সইও করে নিল। কয়দিন বাদে লােক।আসিয়া একটা পেলাস্টিকের ঠ্যাং নাগেয়া দিয়া গেল।মালিক কয় নবকান্ত তাের মন পােষাইলে মাের কত কাজ করিবার পারিস। না পােষাইলে মুই।আপত্তি করিম না’... কয়া ফারাস করি হিসাবের কাগজ নিকিলিয়া কইল, বীমা কোম্পানী থাকি তাের।নামে পাওয়া গেইচে পঞ্চাশ হাজার টাকা। তাের চেলেস্যাৎ আর ঠ্যাং নাগা খরচ হইচে তিরিশ হাজারটাকা। বিষ হাজার টাকা মােরঠে আছে। তুই যদি বাড়ি যাইস তা হইলে নিয়া যাবার পারিস।' ।নবকান্ত মালিকের কথা শুনিয়া আমুচ্চা খায়া গেইল। উয়ায় জানে চেকেস্যা আর ঠ্যাং নাগাখরচ বােলে সরকার থাকি দিচে। অল্পসল্প যা নাগিচে হুটা বােলে যােগেশদায় দিছিল। হিটা কেমন কথা!যােগেশ কাম করি বাড়ি আসিলে নবকান্ত মালিকের তামান কথালা কয়া দিল। যােগেশ তাে কথালাশুনিয়া গরম হয়া কবার ধরিলেক, ছেচেরার বাচ্ছা, গরীব লােকের নক্ত চুষি বড়লােক হবার ধান্দা।পাইসা চখ দিয়া দেখে নাই। নাত্তিটা পােহাউক। কালি সাকালে মালিকক ধরির নাগিবে।।সাকাল হইতে মন্তনে যােগেশ আরও দুইঝন চেঙেরাক ধরিয়া মলিকেরঠে গেইল। কথালাকইতে মন্তনে মালিক আরও উমারে উপুরাৎ তাফালিং গরম দ্যাখেবার ধল্লেক। কবার ধল্লেক,মছলিখাের ঝুটা বাঙালি দাফাদার। মহাজন নােকের বদনাম করিবার তানে সকালে উঠি আসিচেন।খরচ-খরচা বাদ দিয়া নবকান্তর বাকি বিশ হাজার টাকা আছে। উয়ায় নিলে নেউক না নিলে না নেউক।মাের বাড়িত বেশী ঝামেলা করিলে পুলিশক ড্যাকে আনিম’–কয়া ফাকোতে ফোনটা হাতে নিয়ানম্বর টিপাটিপি করিবার ধল্লেক। মালিকের এই নাখান ধপকানিতে উমুরা হাতাশ খায়া গেইল।
যােগেশ ভাবিবার ধল্লেক হামরা তাে মুশুরির মশা। গুণ্ডা পাণ্ডা নাগে দিলে ‘ফৈ চাচা দুয়ার কুদি’। কায় সেলাহামার তানে নাটি ধরিবে। নানান কথা ভাবিয়া মুখখান কালা করিয়া ধুরার পাকে হাটা ধরিল।।শ্যাষম্যাষ বিশ হাজার টাকা নিয়ায় নবকান্ত একদিন এলগাড়িৎ চড়িয়া বাড়ির পাকে ঘাটাধরিল। যেদিন উয়ায় বাড়ি আসিল শুনিতে নাই শুনিতে টারিবাড়ির তামান মানষি চাতার দিয়া ঘিরিধরিল দেখিবার বাদে। সগায় দেখিয়া দুঃখ করিবার ধরিল সগারে মুখত একটায় কথা, চেঙেরাটারজীবনটায় মাটি হয়া গেইল কেংকরিয়া খাবে, আরও কত কি!কাহাে কাহহা বার ধরিল, কাটা ঘাউয়াৎ নুনের ছিটা না দেন। যা হবার তা হয়ায় গেইচে। বাড়িআসিয়া নবকান্ত মহা হজগটত পড়ি গেইল। নিজের মনের অবস্থা যেমন বেভাইল ঐ নাখানে বেভাইল বাপ-মার মন। শ্যাষম্যাষ কয়ঝনের বুদ্ধি ধরিয়া বাড়ির খোলানত নুনের দোকান দিয়া বসিল। নয়ায় নয়ায় লাভ-লােকসানের হিসাবটা বুঝায় গেইল না। কয় মাস পাছােৎবুঝা গেইল ঘরের টাকা সিপােল দিতে দিতে সুদও নাই মূলও নাই।কাহাে কাহহা টিটকারি মারিয়া কইল, ‘উঃ দেশী মানষি দোকান চালাবে! হর দ্যাখ মাড়ােয়ারীগিলাক, বেচাবিক্রিও টনটনা দোকানও ঝিৰ্চা।’ মানষি যেইলা কয় গােটায় ছচা নাহইলেও কণেক আদেক হয়। দোকানখান বসিয়া গেইল। বাড়ির বুড়া বাপ আর কোনাে উপায় নাদেখিয়া কুননা মন্তনে পরার বাড়িত কাম করিবার ধল্লেক। নবকান্ত এলা আর কী করিবে? দিশাসুত্তি হারে ফেলাই। উয়ার চউখের জল আর নাকের শিয়ানী একাকার হয়া গেইল। কান্দিয়া কূল।পায় না। ভাবিয়াও ঠাই পায় না। মনে মনে খালি একটা কথায় ঘুরিফিরি আইসে, ‘কানার পাও খালোতে পড়ে রে, কানার পাও খালোতে পড়ে।

Post a Comment

Previous Post Next Post