ভাওয়াইয়া গান কত প্রকার। কত ধরনের ভাওয়াইয়া গান রয়েছে। kinds of Bhawaiya

ভাওয়াইয়া গানের প্রকারভেদঃ
বাংলা একাডেমী ঢাকা থেকে প্রকাশিত জনাব হাবিবুর রহমান লিখিত' বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত ও ভৌগলিক পরিবেশ, গ্রন্থে বলা হয়েছে, ভাওয়াইয়া গান তিন প্রকার যথা; ভাবমূলক, চটকা ও ক্ষিরল। ভাওয়াইয়া গানে এই তিন ধরনের গান আছে তা গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও ভাওয়াইয়া গান তিন প্রকার, তা গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা ভাওয়াইয়া গানের মূল নায়ক মৈষাল, দীঘলনাশী ও বিচ্ছেদী ভাওয়াইয়ার করুণ বর্ণনা যে এ গানে আছে তা বর্ণনা করা হয়নি। ভাওয়াইয়া গান কত প্রকার তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায় ভাওয়াইয়া গান মূলত ছয় প্রকার।
১।  দীঘলনাশী বা দরিয়া ভাওয়াইয়া
২।  চটকা বা চটুল ভাওয়াইয়া
৩।  ক্ষিরল ভাওয়াইয়া।
৪।  বিচ্ছেদী বা চিতান ভাওয়াইয়া
৫।  মৈষালী বা দোয়ারিয়াল ভাওয়াইয়া
৬।  মাহুত বন্ধুর ভাওয়াইয়া দীঘলনাশী বা দরিয়া
ভাওয়াইয়া দীঘলনাশী বা দরিয়া ভাওয়াইয়াকে অনেকে টানা ভাওয়াইয়াও বলে থাকেন। এ ভাওয়াইয়া উদাস উদাত্ত কণ্ঠে গাওয়া হয়ে থাকে। গানের সুর অবশ্যই উদারা বা মুদারা সপ্তকে শুরু হলে তা, তারা সপ্তকের দিকে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট স্কেলে বেশ কয়েক মাত্রা দাঁড়িয়ে থাকে। আর সুরে থাকার সময় একটি বিশেষভাবে ভাংতি দেয়া হয় বা ভাংতি সুরে গাওয়া হয়। সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ মনে করেন যেহেতু ভাওয়াইয়া গান হিমালয়ের পাদদেশে সৃষ্টি হয়েছে সুরের ধ্বনী পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে প্রতিধ্বনির সৃষ্টি হতে এ কারণেই এ গান ভাংতি সুরে গাওয়া হয়। দীঘলনাশী ভাওয়াইয়া আবার দুই প্রকার যথা :
(ক) ভাবমূলক
(খ) আবেদনমূলক।
ভাবমূলক দীঘলনাশী ভাওয়াইয়া: ভাবমূলক দীঘলনাশী ভাওয়াইয়া ভাবের কথা প্রকাশ্যে ফুটে উঠে। যা মানুষকে ভাবের জগতে বিচরণ করায়। আবেদনমূলক দীঘলনাশী ভাওয়াইয়া: আবেদনমূলক দীঘলনাশী ভাওয়াইয়ায় নারী পুরুরে আবেদন এমনভাবে ফুটে উঠে যা সাধারণত অন্য কোন গানে দেখা যায় না। চটকা বা চটুল ভাওয়াইয়া কোথাও চটকা বা কোথাও চটুল ভাওয়াইয়া নামে পরিচিত। এমন কি কোথাও কোথাও জমানো ভাওয়াইয়া গানও বলা হয়ে থাকে। এ গান মূলত দ্রুত লয়ের হয় চটকা বা চটুল ভাওয়াইয়া দুই প্রকার।
(ক) চটকা সুর প্রধান।
(খ) চটকা কথা প্রধান
কথা প্রধান চটকা বা চটুল ভাওয়াইয়া: অন্যান্য ভাওয়াইয়ার মতো টান থাকে না । এ গানে আলাদা সুর লক্ষ্য করা যায়। যে সুর অন্যান্য সুরের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম : এ সুরের মাঝে তাল লয়, সব মিলে হয়ে উঠে মিষ্টি এক অনুভূতি। কথা প্রধান চটকা বা চটুল ভাওয়াইয়া: সুর প্রধান চটকা ভাওয়াইয়ায় যেমন সুরকে প্রাধান্য দেয়া হয়। কথা প্রধান চটকা ভাওয়াইয়ায় সুরকে প্রাধান্য না দিয়ে কথাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। অর্থাৎ কথাকেই সাজিয়ে গান করা হয়। ক্ষিরল ভাওয়াইয়া দীঘলনাশী ও চটুল ভাওয়াইয়া মতো না। গানগুলো মাঝারী লয়ে গাওয়া হয়ে থাকে। এ ভাওয়াইয়ায় অন্যান্য ভাওয়াইয়ার সুর খুঁজে পাওয়া যায়। ক্ষিরল ভাওয়াইয়ায় এক ধরনের মিষ্টি সুর লক্ষ করা যায়। অনেক ভাওয়াইয়া বিশেষজ্ঞ অনেকভাবেই এ গান বিশ্লেষণ করেছেন। জনাব সিরাজউদ্দীন (প্রাক্তন উপ-মুখ্য প্রযোজক, বাংলাদেশ বেতার, রংপুর) বলেছেন উত্তরাঞ্চলের পায়েসকে বলা হয় ক্ষির যা খেতে খুবই মিষ্টি ও সুস্বাদু। ঠিক তেমনি গানের জগতে ক্ষিরল ভাওয়াইয়াও অত্যন্ত মিষ্টি গান। অনেকটা ক্ষিরের মতো, সেই জন্য ক্ষির এর নামকরণ ক্ষিলর হয়েছে। ক্ষিরল ভাওয়াইয়া দুই প্রকার ।
(ক) কাটা ক্ষিরল
(খ) উল্টা ক্ষিরল
(ক) কাটা ক্ষিরল ভাওয়াইয়া : কাটা ক্ষিরল একটু থেমে গাওয়া হয়ে থাকে। এ ভাওয়াইয়ার বাজনার মধ্যে আলাদা ধরনের কারুকার্য দেখা যায়। অনেক সময় এ গানে সাধারণ মৃদঙ্গ (খোল) মন্দিরা, সারিন্দা ও এক তারের ব্যানা থাকে।
(খ) উল্টা ক্ষিরল ভাওয়াইয়া : কাটা ক্ষিরলের মতো হলেও এ ভাওয়াইয়ায়, ভাওয়াইয়া গানের প্রধান সহযোগী যন্ত্র দোতরা বিশেষভাবে বাজানো হয়। বিচ্ছেদী বা চিতান ভাওয়াইয়া বিচ্ছেদী বা চিতান ভাওয়াইয়া বলতে যে ভাওয়াইয়ায় পল্লীবালার বিচ্ছেদের করুণ চিত্র ফুটে উঠে তাহাই বিচ্ছেদী বা চিতান ভাওয়াইয়া। এ গানে পুরুষের বিচ্ছেদের কথাও থাকতে পারে। উল্লেখ্য যে, বিচ্ছেদী ভাওয়াইয়া বলতে নারী মনের উপচে পড়া ভালোবাসা, হৃদয়ের না বলা কথা, বিরহের অসহনীয় যন্ত্রণাই এ গানে বেশি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বিচ্ছেদী বা চিতান ভাওয়াইয়া তিন প্রকার।
(ক) সাধারণ বিচ্ছেদী বা চিতান ভাওয়াইয়া।।
(খ) কাল্পনিক বিচ্ছেদী বা চিতান ভাওয়াইয়া ।
(গ) আধ্যাত্মিক বিচ্ছেদী বা চিতান ভাওয়াইয়া ।
সাধারণ বিচ্ছেদী বা চিতান ভাওয়াইয়া: সাধারণ বিচ্ছেদী বা চিতান ভাওয়াইয়া বলতে যে ভাওয়াইয়ায় একজনের দুঃখ কষ্ট ও বিরহের কথা প্রকাশ পায় তাহাই সাধারণ বিচ্ছেদী বা চিতান ভাওয়াইয়া । কাল্পনিক বিচ্ছেদী বা চিতান ভাওয়াইয়া: কল্পনার মধ্যে যে গান ফুটে উঠে অর্থাৎ পশু, পাখি, সহ অন্যান্য কিছুর মধ্যে কল্পনা করে যে গান ভাওয়াইয়া করা হয়ে থাকে তাহাই কাল্পনিক বিচ্ছেদী বা চিতান ভাওয়াইয়া।   আধ্যাত্মিক বিচ্ছেদী বা চিতান ভাওয়াইয়া: খোদা, ভগবান, রাসুল, পীর, পয়গম্বর, দেব, দেবতা, গুরু সহ ইত্যাদির উপর যে ভাওয়াইয়া করা হয় তাহাই আধ্যাত্মিক বিচ্ছেদী বা চিতান ভাওয়াইয়া। মৈষালী বা দোয়ারিয়াল ভাওয়াইয়া মৈষালী বা দোয়ারিয়াল ভাওয়াইয়া একটি নির্দিষ্ট পরিসরের ভাওয়াইয়া। বাংলার মহিষের রাখালকে বলা হয় মৈষাল আর এই মৈষালকে ঘিরে যে ভাওয়াইয়া রচিত হয় তাহাই মৈষালী বা দোয়ারিয়াল ভাওয়াইয়া। জানা গেছে মহিষের বাথান নিয়ে মৈষাল যখন মাঠে, প্রান্তরে ঘরে বেড়াত, সকালে বেড়িয়ে যেতো আর ফিরতো সেই সূর্য অস্ত যাবার পর। ঘাড়ে থাকতো দোতারা। এক ঘেয়েমী কাটানোর জন্য মৈষাল নিজেই গান রচনা করে তাল, লয় ছাড়া দোতরা বাজিয়ে একাকী প্রেয়সীর উদ্দেশ্যে গান করতো। আবাব মৈষাল বন্ধুর জন্য অধিক আগ্রহে অপেক্ষা করতে করতে পল্লীবালা তার মৈষাল বন্ধুর জন্য যে ভাওয়াইয়া গাইতো তাহাই মৈষালী বা দোয়ারিয়াল ভাওয়াইয়া । মৈষালী বা দোয়ারিয়াল ভাওয়াইয়া দুই প্রকার।
(ক) আবেগ প্রবণ মৈষালী দোয়ারিয়াল ভাওয়াইয়া
(খ) কল্পনা প্রবণ মৈষালী দোয়ারিয়াল ভাওয়াইয়া
আবেগ প্রবণ মৈষালী দোয়ারিয়াল ভাওয়াইয়া: এ ভাওয়াইয়া উদাস উদাত্ত কণ্ঠে গাওয়া হয়ে থাকে। গানের তালের চেয়ে সুরকে প্রাধান্য দেয়া হয়। গায়ক আবেগ আপুত হয়ে গান করে। সেটা বাস্তবের সাথে কোনো মিল খুজে পাওয়া যাক বা না যাক তা ভাবাবেগের উপর রচিত হয়ে থাকে। কল্পনা প্রবণ মৈষালী দোয়ারিয়াল ভাওয়াইয়া: মৈষাল তার কল্পনাকে প্রাধান্য দিয়ে যে, ভাওয়াইয়া করা হয়ে থাকে, তাহাই কল্পনা প্রবণ মৈষালী বা দোয়ারিয়াল ভাওয়াইয়া। বেশ কিছু গানে কিন্তু লক্ষ করা যায় মৈষাল যে কল্পনা করে নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করে তা বাতবের সাথে কখনো মিল খুজে পাওয়া যায় না বা যাওয়ার কোনও সম্ভাবনাও নেই। বাস্তবতার সাথে মিল না থাকলেও যুগ যুগ ধরে তা প্রচলিত হয়ে আসছে। মাহুত বন্ধুর ভাওয়াইয়া ভাওয়াইয়া এলাকায় এক সময় প্রচুর হাতি পালা হতো। যে হাতি পরিচালনা করে তাকে মাহুত বলা হতো। এই মাহুতরা যে ভাওয়াইয়া গান করতো সেই গানই মাহুত বন্ধুর ভাওয়াইয়া। অবশ্যই এ ধারা প্রায় বিলুপ্ত । দু'একটি গান ছাড়া এ গান খুব একটা দেখা যায় না। বাংলাদেশ বেতার রংপুর কেন্দ্রের সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক, জনাব আজাহার আলী বলেছেন, হাতিকে ধরা বা পোষ মানার জন্য রাত জেগে শীতের মধ্যে আগুন পোয়াতে হতো মাহুতদের, একাকী কাটতো না তাদের কোনও সময়, তারা তাৎক্ষণিকভাবে গান রচনা করে সুরারোপ করে যে গান করতো সেই গানই মাহুত বন্ধুর গান। মাহুত বন্ধুর গান ভারতের আসাম এলাকায় এক সময় বহুল প্রচলিত ছিল এখন তা প্রায় বিলুপ্ত।

তথ্যসূত্রঃ প্রাণের সুর ভাওয়াইয়া।
খন্দকার মোহাম্মদ আলী সম্রাট। 


Post a Comment

Previous Post Next Post