ভাওয়াইয়া অঞ্চল এবং ভাওয়াইয়া গানের প্রচার। Bhawaiya area and Promotion

ভাওয়াইয়ার অঞ্চলঃ
এখন যদিও ভাওয়াইয়া গান বাংলা ভাষাভাষী এলাকা ছাড়া পৃথিবীর যে কোনও দেশে গাওয়া হয়ে থাকে। বিংশ শতাব্দীতে ভাওয়াইযার অবস্থান ব্যাপক না হলেও একটি বিশেষ অবস্থানে স্থান করে নিয়েছে। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। অনেক সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ মনে করেন ভাওয়াইয়া অঞ্চল বলতে রংপুর দিনাজপুর এলাকাকেই বুঝায়। আসলে তা সঠিক নয়। কেননা ভাওয়াইয়া গান তরাই অঞ্চলের গান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর রংপুর দিনাজপুর এলাকা তরাই অঞ্চল অবশ্যই নয়। তাহলে তরাই অঞ্চলের সমগ্র অঞ্চল সংগত কারণে ভাওয়াইয়ার অঞ্চল হিসেবে ধরে নেয়া যায়। তরাই অঞ্চল ছাড়াও ভারতের মালদহ, আসাম, পশ্চিম দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গ, গোয়ালপাড়া অঞ্চল অর্থাৎ আসাম, বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর দিনাজপুর রাজশাহী ও ময়মনসিংহের কিছু এলাকা ভাওয়াইয়া গানের অঞ্চল হিসেবে ধরলে ভুল হবে না

ভাওয়াইয়া গানের প্রচারঃ
পশ্চিমবঙ্গ কোচবিহারের প্রখ্যাত লেখক, খাঁ চৌধুরী আমানতুল্লা সাহেবের বর্ণনা থেকেই বোঝা যায় যে, ভাওয়াইয়া অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গীতের মতো অনাদিকাল থেকে গীত হয়ে আসছে। হয়তোবা ভাওয়াইয়া নামে নয় মৈষালী বা অন্য কোনো নামে। কিন্তু বাইরে জনগণের কাছে এই গান প্রচার লাভ শুরু করে তিরিশের দশক থেকে গ্রামোফোন রেকর্ডের মাধ্যমে। তিরিশের দশকে এ অঞ্চলে কিছু প্রতিভাধর শিল্পীর প্রতিভার পরিচয় দিতে সাহায্য করে আধুনিক গ্রামোফোন রেকর্ড। যার মাধ্যমে ভাওয়াইয়া গান লোকসমক্ষে পরিচিতি লাভ করে এবং অদূর ভবিষ্যতে এ সঙ্গীত ধারা মাধ্যমে ভাওয়াইয়া গান লোকসমক্ষে পরিচিতি লাভ করে এবং কোন পথে যাবে সেই দিক নির্ণয়ের সাহায্য করে।  বস্তুতপক্ষে, গ্রামোফোন রেকর্ড ধরা না থাকলে এর অধিকাংশই গানই আজ হয়তো হারিয়ে যেত বা অপরিচিত থেকে যেত। আবার মুখে মুখেও যদি পাওয়া যেত তার সুর, তাল বিকৃত হয়ে আংশিক টিকে থাকতো। এই গ্রামোফোন রেকর্ডের মাধ্যমে ভাওয়াইয়াকে ধরে রাখার ব্যাপারে এবং গ্রামীণ শিল্পীদেরকে লোকসমক্ষে তুলে ধরার ব্যাপারে গ্রামোফোনের ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। গ্রামোফোন কোম্পানির মাধ্যমে যার অক্লান্ত প্রচেষ্টার জন্য এ কাজ সম্ভব হয়েছে, তিনি হলেন পশ্চিমবঙ্গের (ভারত) কোচবিহার নিবাসী স্বর্গীয় হরিশচন্দ্র পাল মহাশয়। স্বর্গীয় পাল মহাশয়ের কাছে ভাওয়াইয়ামোদীরা বিশেষ ভাবে ঋণী।।  যে শিল্পীদের প্রতিভার ফলস্বরূপ আমরা বর্তমান ভাওয়াইকে পাই তাদের সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। ভাওয়াইয়া সঙ্গীত ধারাকে গ্রামোফোনে স্থান দিতে প্রথমে আসেন কোচবিহার শহর ও শহরতলীয় শিক্ষিত সম্প্রদায়। গ্রামীণ শিল্পীরা আসেন অনেক পরে। যতদূর জানা যায় স্বর্গীয় সুরেন্দ্র নাথ রায় বসুনিয়া ১৯৩৭ সালের নভেম্বর মাসে “বাড়িতে নতুন বউ আসিয়া ও পরশী আপন নয় বান্ধবরে" গান দু'টি প্রথম রেকর্ড করেন এবং সেই থেকেই ভাওয়াইয়া গান দেশ বিদেশে, গ্রামে গঞ্জে প্রচারের যাত্রা শুরু করে। ঐ রেকর্ড সারা ভারতবর্ষে নতুন করে সাড়া জাগায়। ভাওয়াইয়া ম্রাট আব্বাস উদ্দিনের বন্ধু ও গুরু স্বর্গীয় সুরেন্দ্র নাথ রায় বসুনিয়া আব্বাস উদ্দিনকে ভাওয়াইয়া গান করার অনুরোধ জানান।  তখন আব্বাস উদ্দিন যিনি সেই সময় নজরুল গীতির অনুশীলন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তার অনুরোধে নজরুল গীতির অনুশীলন কমিয়ে দিয়ে ভাওয়াইয়া ও পল্লীগীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন। একে একে অনেক ভাওয়াইয়া গান রেকর্ড করে সমগ্র দেশে ভাওয়াইয়া সঙ্গীত পিপাসুদের মাঝে সৃদৃঢ় অবস্থান করে নেন। (তথ্য সূত্র: মধুপণী বিশেষ কোচবিহার জেলা সংখ্যা-১৩৯৬, পৃষ্ঠা ৩৭০)।  ভাওয়াইয়া গানের ঐ রেকর্ডগুলোর সুনাম সুডাকে তারপর একে একে গ্রামের দক্ষ গীদালগণ এগিয়ে আসেন রেকর্ড করতে। অবশ্য হরিশচন্দ্র পাল, সুরেন্দ্র নাথ রায় বসুনিয়া ও আব্বাস উদ্দিন মহোদয়ের গান গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেললে হয়তো পরবর্তী কোনও শিল্পীর পক্ষে রেকর্ড করা সম্ভব হতো না বা রেকর্ড কোম্পানিও আগ্রহ প্রকাশ করতো না। চল্লিশের দশক থেকে যেই সব শিল্পীদের আমরা দেখতে পাই। পশ্চিমবঙ্গে এদের মধ্যে বিখ্যাত সর্ব জনাব নায়েব আলী টেপু, কেশব বর্মণ, প্যারীমোহন দাস, গঙ্গাধর দাস, যত্নেশ্বর বর্ষণ, ধনেশ্বর রায়, কেদার চক্রবর্তী, বিরজা মোহন সেন প্রমুখ। শেষোক্ত দু’জন অবশ্য গিদাল ছিলেন না। গ্রামীণ গীদাল শিল্পীদের প্রত্যেকের কণ্ঠ ছিল স্বকীয়তায় ভরা। এদের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান দখল করে ছিলেন স্বর্গীয় নায়েব আলী টেপু ও স্বর্গীয় কেশব বর্মণ। আবার শিল্পী ও গীতিকার হিসেবে যিনি সব চেয়ে বিশিষ্টতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি হলেন প্যারীমোহন দাস। মরহুম আব্বাস উদ্দিনের বাল্যবন্ধু । ভাওয়াইয়া স্বকীয়তা রক্ষায় সংগ্রাম করেছেন শ্রী দাসের মতোই শিল্পী। যন্ত্র শিল্পী এবং গীতিকার হিসেবে ভাওয়াইয়া পুষ্টি সাধন করেছিলেন স্বগীয় কেশব বর্মণ। তিনি গ্রামোফোন রেকর্ডে মরহুম আব্বাস উদ্দিনের সঙ্গে দোতরা শিল্পী হিসেবে প্রবেশ করেন। পরে নিজে শিল্পীর ভূমিকায় অংশ গ্রহণ করেন। তিনি প্রায় পাঁচশতের মতো ভাওয়াইয়া গান এবং ২৬ খানি নাটক রচনা করেন। মূল গীদালের ভূমিকায় বিষহারা পালা তার প্রধানতম কৃতিত্বের সাক্ষর। মূলত মনসা মঙ্গল, পৌরাণ্ডি ধর্মীয় কিছু পালাগান সে সময় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। সেই সময়কে পালাগানের স্বর্ণ যুগ বললে ভুল হবে না । ভারতের আসাম রাজ্যের গোয়ালপাড়া জেলার খেবাড়ি গ্রামে জন্মান্ধ মহান শিল্পী টগর অধিকারীর জন্ম ১৯১২ সালে। পার্শ্ববর্তী গ্রাম কোচবিহার জেলার রাজার কুঠির প্রিয়নাথ রায় যিনি প্রিয়নাথ ওস্তাদ নামে পরিচিত ছিলেন- তার কাছেই গান ও বাজনার হাতে খড়ি। অল্প দিনের মধ্যে দোতরায় বিশেষ পারদর্শী হয়ে উঠেন। পরবর্তীকালে সুরেন্দ্রনাথ বসুনিয়ার সাথে রেকর্ডেও তিনি দোতরা বাজান। সারা ভারত যন্ত্র ও কণ্ঠ সঙ্গীত প্রতিযোগিতা (বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত), কলকাতায় অনুষ্ঠিত সারা ভারত সংস্কৃতি সম্মেলনে ও শান্তি উৎসব প্রভৃতিতে দোতরা বাদক হিসেবে অংশ গ্রহণ করেন। দোতরায় বিভিন্ন রাগ রাগিনী বাজিয়ে শ্রোতাদেরকে মুগ্ধ করেন। অবশ্য দোতরার ডাং (Strok) এর চরম রসাবেদন মূর্ত হয়ে ওঠে ভাওয়াইয়ার সুরেই। এখানে উল্লেখ করতে হয়, তার বিখ্যাত সুর সৃষ্টি ‘বিয়ের আসরের বাজনা' । বিয়ের মণ্ডপে মেয়ে কাঁদছে, মেয়ের মা কাঁদছে, আসন্ন কন্যা বিদায়ের জন্য, সঙ্গে উলু ধ্বনি, ঢাকের আওয়াজ ও সানাইয়ের বেহাগ সব কিছু মিলিয়ে জীবনে বিয়ে বাড়িতে যে সুর বেজে উঠে তারই হুবহু প্রকাশ ছিল তার সৃষ্ট অপূর্ব সুরমৃচ্ছনা।  এখনও অনেকের কাছেই শোনা যায় দোতরার এই বিখাত শিল্পীর দারিদ্র তাড়িত জীবনের কথা। যার দোতরার সুরমূৰ্ছনায় একদিন পণ্ডিত রবিশঙ্কর মুগ্ধ হয়েছিলেন । চরম দারিদ্রের মধ্যে সে প্রতিভা একদিন নীরবে নিভৃতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ঐ খেরবাড়ি গ্রামেই।

তথ্যসুত্রঃ প্রাণের সুর ভাওয়াইয়া।
—খন্দকার মোহাম্মদ আলী সম্রাট।     

Post a Comment

Previous Post Next Post