ভাওয়াইয়া গানের নামকরণ | bhawaiya gaaner name koron

মহা মহোপাধ্যায় যাদবেশ্বর তর্করত্ন বলেছেন “বোধকরি পূর্বরাগ লইয়াই প্রথম ভাওয়াইয়া গান সৃষ্টি হইয়াছে। সে জন্য ভাব শব্দের প্রাকৃত ভাও রাজবংশী ভাষায় ভাওয়াইয়া নামের নামকরণ হয়েছে। অর্থাৎ ভাওয়াইয়া বা ভাওইয়া শব্দটি প্রাকৃত “ভাও” যার অর্থ ভাব এবং সংস্কৃত আওয়াই অর্থাৎ জনরব ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের রূপ নিয়েছে। যে গান স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফুটিয়ে তোলে প্রাণের আবেগ ও আকাঙ্খাকে, শ্রোতার জন্য প্রতীক্ষা না করে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে যুগ যুগ ধরে প্রতিষ্ঠা লাভ করে আছে তাহাই ভাওয়াইয়া। ভাওয়াইয়া আলোচনায় স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে- ভাওয়াইয়া' শব্দের অর্থ কী? এ সম্পর্কে স্বর্গীয় সুরেন রায় মহাশয়ের অভিমত হলো ভাবপূর্ণ যে গীত মানুষকে ভাববিহ্বল করে দেয় তাই ভাওয়াইয়া'। ভাব> ভাও+ইয়া=ভাওইয়া তাই ভাওইয়ার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যে ভাবে' অর্থাৎ ভাবুকের গান। যেমন আমাদের উত্তরাঞ্চলে বৃহত্তর রংপুরে, যে খায় তাকে খাওয়াইয়া, যে যায় তাকে যাওয়াইয়া বলে সম্বোধন করা হয় । এই গান জল-ভাতের মতো এত সরল ও স্বাভাবিক যে, গাওয়ার সঙ্গেই ভাব বোঝা যায় এবং একেবারেই আধুনিক হেঁয়ালী বর্জিত। যে জন্য এই গানের নাম হয়েছে ভাওয়াইয়া অর্থাৎ automatic গান বা ক্ষুদ্রতম শিল্প, সুর ও ছন্দের স্বাভাবিক বিকাশ । যখন মানুষ ভাবতে শিখেছিল বা সুর ছন্দে যা ভেবেছিল তখনই তার ভাবধারা হতে এর উৎপত্তি হয়েছিল। প্রখ্যাত ভাওয়াইয়া গবেষক গৌরীপুর (গগায়ালপাড়া) নিবাসী শ্ৰী শিবেন্দ্রনারায়ণ মণ্ডল মহাশয়ের মতে ভাব শব্দ হতে ভাওয়াইয়া গানের উৎপত্তি হলেও এখানে ‘ভাব’ শব্দ অন্য অর্থ বহন করে। গোয়ালপাড়া জেলায় (আসাম, ভারত) ভাব শব্দ প্রেম বা ভালোবাসা শব্দের প্রতিশব্দ রূপে ব্যবহৃত হয়। নরনারীর প্রেম সম্বন্ধীয় হওয়ার জন্য ঐ সকল গানের নাম ভাওয়াইয়া হওয়াও সম্ভব হতে পারে। কিন্তু যদি ভাওয়াইয়া শব্দের উৎপত্তি ভাব শব্দ হতে না হয়ে থাকে এবং শব্দটি তদ্ভব শব্দ না হয়ে খাটি দেশজ শব্দ হয়ে থাকে তা হলে ভাওয়াইযা শব্দে অর্থ অন্যরূপ হতো। ভাওয়াইয়া গান বলতে যে গান মনকে উদাস করে বা মনকে ঘরছাড়া করে সেই গানকে বুঝাবে। সুতরাং ভাওয়াইয়া গানের অর্থ ‘মনকে উদাস করা গান' হওয়াই অধিক যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। ভাওয়াইয়া শব্দের অর্থ উৎপত্তি প্রসঙ্গে বিশিষ্ট গবেষক যতীন্দ্র দে সরকার মহাশয় প্রখ্যাত ভাওয়াইয়া সগ্রাহক আব্দুল করিম সাহেবের অভিমত উল্লেখ করেছেন। অনেক ভাওয়াইয়া শিল্পীর সঙ্গে তিনি একমত যে, ভাওয়াইয়া গানের জন্ম ‘ভাওয়া' শব্দ থেকে। 'ভাওয়া' মহিষের চারণ ক্ষেত্র, মরা নদীর দোলা জমিতে জাত মধুয়া কাশিয়ার বন। ভাওয়া' অর্থাৎ মহিষের চারণ- ক্ষেত্র। মহিষের রাখালেরা (মইলেরা), মাসের পর মাস মহিষ চরিয়ে বেড়ানোর সময়ে মহিষের পিঠে বসে দোতরা বাজিয়ে এ গান করতো। গানের উৎস স্থান ‘ভাওয়া থেকে এ গানের নাম ভাওয়াইয়া হয়েছে।
আবার অনেকের মতে ভাওয়াইয়া কথাটি বিকৃত/বিবর্তিত হয়ে বাওয়াইয়া' থেকে এসেছে। বাও মানে বাতাস। মৈষালের গানের সুর মধুয়া কাশিয়ার বন থেকে চাষিদের গাওয়া গানের সুর, পাতার (ফাঁকা মাঠ) থেকে বাও বাতাসে ভেসে লোকালয়ে আসত। সেই জন্য এই গানের নাম হয়েছে বাওয়াইয়া যার পরবর্তীতে ভাওয়াইয়া নামে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।  ‘ভাব' ভাওয়া', বাও' ইত্যাদি কোনও শব্দ থেকে ভাওয়াইয়ার উৎপত্তি সে বিতর্কে গিয়ে লাভ নেই। ভাওয়াইয়া নামে উৎপত্তি যে ভাবেই হোক না কেন, এই সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে ভাওয়াইয়ার একটি গ্রহণযোগ্যতা সংজ্ঞা হতে পারে- ভাওয়াইয়া রাজবংশী বা কামরূপী ভাষায় গীত দীর্ঘ ছন্দের ও বিলম্বিত তালের লোকসঙ্গীত যার মাধ্যমে পাওয়া যায় রাজবংশীদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ও লোকায়ত জীবনের অভিব্যক্তি। ভাওয়াইয়া বলতে তাই দরিয়া সুরের গানগুলোকে বোঝায়। পরবর্তীকালে তার মধ্যে চটুলতা আসে ধীরে ধীরে চটকা' রূপে সেগুলো গীত হতে থাকে। অন্য যে কোনও আঞ্চলিক সঙ্গীতের মতো এর নিজস্বরূপ, ঠং ও রং আছে। ভাওয়াইয়া বিশুদ্ধি নির্ভর করে রাজবংশী ভাষায় ভাষাজ্ঞান, সুষ্ঠু উচ্চারণ ও কণ্ঠধ্বনি নৈপুণ্য এবং সেই জন্য রাজবংশী ভাষা অঞ্চলের বাইরের গায়কের পক্ষে শুদ্ধভাবে ভাওয়াইয়া গান করা দুঃসাধ্য। ভাওয়াইয়া আঞ্চলিক সঙ্গীত। আঞ্চলিক লোকসঙ্গীতের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর ভাষা। আঞ্চলিক জবান অর্থাৎ রাজবংশী উপভাষা ভাওয়াইয়ার বাহন। অনেক ভাষাতাত্ত্বিক এই উপভাষার নাম আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র অর্জন করেছিল যার সঙ্গে বাংলার অন্য অঞ্চলের কথ্য ভাষা কিংবা বাংলার সাধারণ সাহিত্যিক ভাষার কোনও মিল নেই। এই ভাষার উচ্চারণ ভঙ্গিও স্বতন্ত্র। এই অঞ্চলের ভাষা সম্প্রদায় সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে পণ্ডিতেরা দেখতে পেয়েছেন যে, এই ভাষা সম্প্রদায়র একটা বড় অংশ মোঙ্গল নরগোষ্ঠীর অন্তর্গত। এই নরগোষ্ঠীর আদি ভাষা ছিল, ভোটচীনা ভাষা বংশের অন্তর্ভুক্ত। ধ্বনি তত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে তাই এই অঞ্চলের উচ্চারণে ভোটচীনা প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। শব্দরূপ, ধাতুরূপ ও কিছু কিছু প্রত্যয় ব্যবহারের প্রতিবেশি অসমীয়া ভাষার সঙ্গেও এর যোগাযোগ খুব বেশি। সুদুর অতীতে এই অঞ্চলের সমস্ত মানুষই সম্ভবত ভোটচীন ভাষায় কথা বলতো। পরে ভারতের অন্য অংশের বিভিন্ন জাতীয় সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাবে এখানে ভারতীয় আর্য ভাষার প্রসার ঘটতে থাকে, যদিও ঠিক কোন সময়ে এটা ঘটে তা নিশ্চিত বলা কঠিন তবে এই উপ- ভাষার সর্বাংশই আর্য ভাষার অধীন নয়; এর ধ্বনি তত্ত্বে কোথাও কোথাও রূপ তত্ত্বে, বিশেষত শব্দ ভাণ্ডারে আর্যেতর উপাদান প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। আর্য ভাষার আপেক্ষিক শ্ৰেষ্ঠতার আকর্ষণ অস্বীকার করতে না পারলেও এ অঞ্চলের মানুষ তাদের উচ্চারণ ভঙ্গির আদি বৈশিষ্ট্য, পুরাতন ভাষা গোষ্ঠীর শব্দ ভাণ্ডারের একটি অংশ, পদ প্রয়োগর সিদ্ধরীতি। এগুলো একেবারে ত্যাগ করতে পারেনি। প্রধানত আর্যতর উপাদানের সমৃদ্ধ এ ধরনের একটি উপভাষাই (তাকে রাজবংশী বা কামরূপি যাই বলা হোক না কেন) ভাওয়াইয়ার বাহন। অখ্যাত, অজ্ঞাত, নিরক্ষর কবি শিল্পী দ্বারা উপরোক্ত উপভাষায় রচিত এ গানগুলো অনাদিকাল থেকে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে চলে আসছে। স্বভাবত কিছু কিছু রূপান্তর বিশেষ করে কথা রূপান্তর ঘটেছে অনিবার্যভাবেই। অনেক সময়ে হয়তো ভাষাতে মিশ্রণ এসেছে কিন্তু গানের ভিত্তি গড়ে উঠেছে রাজবংশী ভাষাতেই। বিষয়গত দিক থেকে এ অঞ্চলের লোকসঙ্গীতের মধ্যে ফুটে উঠেছে। একটি গ্রাম্য অনগ্রসর কৃষিজীবী নৃগোষ্ঠীর (প্রধানত রাজ বংশীর) আর্থ সামাজিক জীবনের মূল বৈশিষ্ট।  অন্যান্য অঞ্চলের লোকসঙ্গীতের মতো ভাওয়াইয়াতেও প্রেম বিষয়ক গানই বেশি। কিন্তু প্রধান বিশেষত্ব হলো গানের মধ্যে জীবনকে পরিপূর্ণরূপে প্রতিফলিত করার সরল ও অকপট প্রয়াস। নর-নারীর জীবনে যত কম রকম পরিস্থিতি উদ্ভব হতে পারে তা সবই এই প্রেম বিষয়ক গানের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। নারী পুরুষের চিরন্তন ভালোবাসার কথাতো আছেই। স্বামী যৌন ক্ষমতাহীন হওয়ার জন্য নারী মনের ক্ষোভ, বিধবা নারীর প্রেমাসক্তি অবৈধ প্রণয়, বাল্য প্রেমের অসহনীয় যন্ত্রণা, পরকীয়া প্রেম- এ সব কিছুর সরল ও অকপট প্রকাশ ঘটেছে এই ভাওয়াইয়াতে।  কৃষি ও কৃষকের এ সমাজে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। কৃষক রোদে পুড়ে, জলে ভিজে সমগ্র জাতির অন্ন সংস্থান করে কিন্তু কৃষকের চিরকালই সমাজ তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে এসেছে। এ কৃষির উপর ভিত্তি করেই ভাওয়াইয়ার জন্ম ও লালন পালন। এ প্রসঙ্গে ভাওয়াইয়ার প্রাণ পুরুষ আব্বাস উদ্দিনের নিজের কথায় বাড়ির পূর্বে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। আমাদের আধিয়ারী প্রজারা হাল বাইতে বাইতে পাট নিড়াতে নিড়াতে গাইতো ভাওয়াইয়া গান .... সেই সব সুরই আমার মনের নীড়ে বেঁধেছিল ভাওয়াইয়া গানের পাখি”।  রিমিঝিমি বৃষ্টিতে হাল চালাতে চালাতে অংবা ধান পাট ক্ষেত নিড়ানীর কাজ চলা কালীন প্রায় সবার কণ্ঠেই শোনা যায় ভাওয়াইয়া, কণ্ঠে সুর থাকুক বা না থাকুক। কাজের তালে তালে শুরু হয়ে যায়-
ও ধন মোর কানাইয়ারে,
এ্যালুয়া কাশিয়ার ফুল,
নদী হইছে কানাই হুলুস্থুলরে,
ক্যামন করিয়া দরিয়া হবে পার,
ধন মোর কানাইয়ারে।
অথবা
ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে
ফান্দ বসাইছে ফান্দি ভাইয়া পুঁটি মাছ দিয়া
পুঁটি মাছের লোভে বগা পড়ে উড়াল দিয়ারে।
ঐ গানে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাশের ক্ষেত থেকে অন্য কেউ গান ধরে- আগা নাওয়ে ডুবো ডুবো পাছা নাওয়ে বইসো ঢোঙায় ঢোঙায় ছ্যাঙ জলরেঃ ও কইন্যা পাছা নাওয়ে বইসোর ...ইত্যাদি।
কেউ হয়তো শুরু করতো, “ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে"। সে গান শেষ হতে না হতেই অন্য কেউ ভাঙ্গা গলাতেই শুরু করলো, “ও মোর কাগারে কাগা কন কাগা মোর মাও বা কেমন আছেরে, যখন মাও মোর আন্দে বাড়ে---ইত্যাদি। আবার প্রবীণ ভাওয়াইয়া শিল্পীদের বলতে শোনা যায় কাশ ও নলখাগড়ার বিস্তীর্ণ চরকে ভাওয়া বলা হয়। আর এই ‘ভাওয়া থেকে ভাওয়াইয়া কথাটি এসেছে। কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন কাশবন ও নলখাগড়া নিয়ে অনেক ভাওয়াইয়া গান গাওয়া হয়ে থাকে।
হামরা বোলে মৈষলরে দেড় টাকার চাকুরি করি 
আমরা নোহাই ভাল্ 
নল খাগড়ার উজ্জর ঘুতায় হাটুয়ার গেল ছালরে।
 অথবা
ও মুই না শোনোং না শোনোং তোর বৈদেশিয়ার কথারে 
ও মোক ছাড়িয়া গেলু ক্যানে। 
আইলে আইলে আইল কাশিয়া গাত পড়ে ঢুলিয়া 
ও তুই আসিবু বলিয়া গেলু যে ছাড়িয়া এ্যাকেলায় ফেলেয়ারে 
ও মোক ছাড়িয়া গেলু ক্যানে।
 বিশিষ্ট সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ, লেখক ও গবেষক বাবু সুকুমার রায় তার ভারতীয় সঙ্গীত ইতিহাস ও পদ্ধতি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ভাওয়াইয়া দোতরার গান স্বরূপ বর্ণিত হয়। ভাওয়াইয়া শব্দটি কেউ কেউ ভাবগীতির অর্থে ব্যবহার করেন। বাংলাদেশের বেতার রংপুর কেন্দ্রের প্রাক্তন উপ-মুখ্য প্রযোজক জনাব সিরাজ উদ্দিনের কাছ থেকে জানা গেছে, তিনি তাঁর ওস্তাদের কাছে শুনেছেন উত্তরাঞ্চলের বিরহী বালার উচ্চ কণ্ঠে নিঃসৃত আবেগপ্লুত কণ্ঠের গানই ভাওয়াইয়া'। তিনি জানান উত্তরাঞ্চলের কথা, ভাষা, ভাও, য়াইয়া থেকে এ গানের জন্ম বা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন উত্তরাঞ্চলের ভাষা ছাড়া অন্য কোনও এলাকার ভাষা খুব একটা ভাওয়াইয়া গানে দেখা যায় না। অবশ্য ভাওয়াইয়া ম্রাট আব্বাস উদ্দিনের গানে ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায় তিনি আরো বলেন, উত্তরাঞ্চলের ভাষায় ‘ভাও' অর্থ মূল্য যেমন কথায় কথায় অনেককে বলতে শোনা যায় লোকটার ইদানিং খুব ভাও’ অর্থাৎ মূল্য বা দাম হয়েছে। আর য়াইয়া অর্থ ব্যক্তি অর্থাৎ উত্তরাঞ্চলে যে বলে তাকে বলাইয়া, যে শেখায় তাকে শেখাইয়৷ বলা হয়। অনেক গানে তা লক্ষ করা যায় যেমন- “তোমরা কেমন কওয়াইয়া মন কাড়িয়া নিছেন তোমরা কয়া ভাওয়াইয়া”। ভাওয়াইয়া গান এই মূল্য ও ব্যক্তি হতে সৃষ্ট এবং এই জন্য ভাওয়াইয়া নামে পরিচিতি লাভ করেছে। তিনি আরো বলেন এই ভাওয়াইয়া গান এক সময় খুবই মূল্যবান গান ছিল। দর্শক শ্রোতারা ভাবতো এবং জানতো, সঙ্গীত জগতে ভাওয়াইয়া গানই এক মাত্র গান। এ গান সবাই গাইতে এবং করতে পারে না। কোনও এক সময় ভাওয়াইয়া গায়কদের অত্যন্ত উচ্চমানের গায়ক হিসেবে ধরা হতো। সমাজে তাদের স্থান ছিল অন্য দশজন গায়কের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম। অবশ্য এখন তা গ্রহণযোগ্য নয় বরং উল্টোটাই হয়ে থাকে। ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের পুত্র, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর প্রাক্তন মহা পরিচালক, বাংলাদেশ টেলিভিশনের এক সময়কার উপস্থাপক, বিশিষ্ট ভাওয়াইয়া শিল্পী জনাব মোস্তফা জামান আব্বাসী বেতার বাংলা জানুয়ারি-মার্চ ৯৮ পত্রিকায় লিখেছেন। মেঠো সুরের গান বলতেই বুঝায় ভাওয়াইয়া গান। তিনি আরো লিখেছেন নারী বিরহের আকুতি, বেদনাহত নারীর ক্রন্দনই ভাওয়াইয়া। ভাব থেকে ভাওয়া অথবা ভাব-য়াইয়া থেকে ভাওয়াইয়া গানের নামকরণ করা হয়েছে। রংপুরের বিশিষ্ট প্রবীণ নাট্যকার, নাট্যপরিচালক ডা. আশুতোষ দত্ত খুবই জোর দিয়ে বলেন ১৭৮৩ খ্রিঃ নবাব নূর উদ্দিন, ভবানী পাঠক ও মন্থনার জমিদার জয়দুর্গা দেবী চৌধুরাণী দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজাদের বিদ্রোহের পরিচালনার ভার গ্রহণ করেছিলেন। তারা শত্রুর মোকাবেলা করতে তৎকালীন একমাত্র দ্রুত যানবাহন হিসেবে নৌকা ব্যবহার করতেন। ছিপ নৌকা ব্যবহারে এরা ছিল সিদ্ধহস্ত। উক্ত ছিপ নৌকার স্থানীয় নাম ছিল ভাওয়াইল্লা। আর এই ভাওয়াইল্লা পরবর্তীতে হয়েছে ‘ভাউলা'। উল্লেখিত ভাওয়াইল্লার মাঝিতে গীত সঙ্গীত ‘ভাওয়াইয়া' নামে পরিচিত লাভ করে। তিস্তা, করতোয়া, ধরলা ব্রহ্মপুত্রের জলে ভাওয়াইল্লা অর্থাৎ ছিপ এবং স্থলের বাহন একমাত্র গো মহিষের গাড়ি। তাই ভাওয়াইয়া গানে এই দ্বিবিধ যানবাহনের চলার গতি ও খাদ নির্ভর সুর ভাওয়াইয়া গানে বিধৃত।

তথ্যসূত্রঃ প্রাণের সুর ভাওয়াইয়া।
—খন্দকার মোহাম্মদ আলী সম্রাট


Post a Comment

Previous Post Next Post