ভাওয়াইয়া গানের উৎপত্তি | Origin of Bhawaiya song

ভাওয়াইয়া গানের উৎপত্তি কিভাবে হয়েছে সে সম্পর্কে তেমন কোনো অনুসন্ধান হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। হলেও হয়তো ব্যাপক আকারে হয়নি বলে আমার ধারণা। তবে ভাওয়াইয়া গান যে অতি প্রাচীন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সঙ্গীত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন হিমালয়ের পাদদেশীয় তরাই অঞ্চলের গানই ভাওয়াইয়া গান। তরাই অঞ্চল বলতে হিমালয়ের নিমুদেশ বা উপত্যকা অঞ্চল অর্থাৎ জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার এলাকাকে বুঝায়। পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত বিস্তীর্ণ এলাকার গানই ভাওয়াইয়া গান। ভাওয়াইয়া আজ সারা পৃথিবীতে একটি সমৃদ্ধ লোকসঙ্গীত ধারা হিসেবে পরিচিত। কিংবদন্তি আছে যে, সে সময় যাতায়াত ব্যবস্থার মাধ্যম ছিল গরু বা মহিষের গাড়ি, এই গাড়ি চালককে বলা হয় গাড়িয়াল বা গাড়োয়ান। এই গাড়িয়াল বা গাড়োয়ান যখন একাকী দূর দূরান্তে গাড়ি নিয়ে পরিবহণের জন্য যেত, তখন উদাস উদাত্ত কণ্ঠে নিজে গান রচনা করে সুরারোপ করে যে গান করতো সেই গানই ভাওয়াইয়া গান । এ ভাবেই ভাওয়াইয়া গানের সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে, গাড়ি চলার সময় গাড়ির চাকা উঁচু নিচু খাদে পড়ে যে ঝাকুনির সৃষ্টি হতো তাতে গানের সুরে আঘাত করতো। সে কারণেই ভাওয়াইয়া গান ভাংতি সুরে গাওয়া হয়। অনেক সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ মনে করেন ভাওয়াইয়া গান তরাই অঞ্চলের গান নয়, এ গান সাধারণ মানুষের গান। যারা সারাদিন মাঠে কাজ করতো, অভাবের কারণে দু'মুঠো খাবার জুটতো না, কিন্তু তাদের মধ্যে ছিল প্রেম, প্রীতি ভালোবাসা ও ভাব। এই ভাব থেকে ভাও আর ভাও থেকে ভাওয়াইয়া সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি অনেকে বলেন, অবিভক্ত বাংলায় সুখের কোনও কমতি ছিল না। মানুষে মানুষে ছিল খুবই সম্প্রীতি। একে অন্যের সুখে দুঃখে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল। জনসংখ্যা কম থাকায় খুব অল্প পরিশ্রমেই সারা বছর খাবার জুটতো তাদের। অর্থাৎ খাল, বিল, নদী নালায় পাওয়া যেত প্রচুর মাছ। জমি জমা ছিল উৰ্ব্বর। ফসল উৎপাদনের সময় ছাড়া সারা বছর বসে বসেই চলতো তাদের জীবন যাপন। অনেকটা অলস প্রকৃতির মানুষ হিসেবে মনে হয় আজকের যুগের সাথে তুলনা করলে। সেই মানুষগুলো নিজেরাই গান রচনা করে নিজেরাই সুর করে প্রাণ খুলে গান করে আনন্দ লাভ করতো সেই গানই ভাওয়াইয়া। অপর এক তথ্যে জানা গেছে পল্লীবালার হৃদয়ের কথা, ভালোবাসার কথা দিয়ে যে সৃষ্টি হয়েছে তাহাই ভাওয়াইয়া। ভাওয়াইয়া গানের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণে দেখা যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারী মনের নানাবিধ ভাবের অভিব্যক্ত প্রকাশ পেয়েছে। আবাব অনেকে এও মনে করেন যমুনা নদীর পশ্চিম পাড়ের নৌকার মাঝিদের গান ভাওয়াইয়া গান। কোনও এক সময় ঐ মাঝিদের গান পরবর্তীতে বিস্তৃতি লাভ করলেও তা টিকে থাকতে পারেনি। সেই গানই ভাওয়াইয়া গান। সঙ্গীত বিশারদরা সকলই একমত হয়েছেন যে, ভাওয়াইয়া গান তরাই অঞ্চল অর্থাৎ হিমালয়ের পাদদেশীয় গান। এই যুক্তির গ্রহণযোগ্যতাও আছে। কিন্তু প্রশ্ন উদ্ভব হয়, তরাই অঞ্চলে এ গানের উৎপত্তি হলে, তরাই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা পায়নি কেন। তারা মনে করেন, না পাওয়ার প্রধান কারণ তরাই অঞ্চলে বসতি কম, সেই কারণে রংপুর দিনাজপুর এলাকায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আজকের দিনে যেমন শিল্পী, গীতিকার, সুরকারদের তালিকা থাকছে, রেকর্ড থাকছে, সৃষ্ট সময় তা ছিল না। ছিল না কোনো ভাওয়াইয়া গানের পাণ্ডুলিপি। যার কারণে ভাওয়াইয়া গান মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করতে পারেনি। এর কারণ, মুখে মুখে রচনা করে গাওয়া হতো এবং একটা সময় তা বিলীন হয়ে যেত। আরও কারণ হিসেবে দেখা যায় একটি গান সৃষ্টির পর থেকেই সেই গানের কথা, সুর, তাল, লয় প্রতিনিয়ত বদলিয়ে, সে গানটি বিশেষ অবস্থায় এসে দাঁড়ায়। এক সময় তরাই অঞ্চল বন্ধুর চারণ ভূমিতে সমৃদ্ধ ছিল। প্রচুর মহিষের বাথান দেখা যেতো। যে মহিষ চরিয়ে বেড়াতো বা পালককে বলা হতো মৈষাল বা মইষাল । সূর্য উঠার সাথে সাথে মহিষের বাথান নিয়ে তৃণভূমিতে যাওয়া ছাড়া তাদের কোনো কাজ থাকতো না। কাটতো না তাদের সময়। একাকী নির্জনে তাদের মন বিষিয়ে উঠতো ঠিক ঐ সময় তারা আপন মনে গান বাঁধতো এবং তাৎক্ষণিকভাবে সুরারোপ করে তাল, লয়, বিহীন আপন মনে গান গেয়ে উঠতো। তাদের এই সুর পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে বাতাসের মধ্যে বিশেষ ধরনের কম্পনের সৃষ্টি করতো, যার কারণে এ গানের গায়কের কণ্ঠস্বর ভেঙ্গে ভেঙ্গে উচ্চারিত হতো বা এখনো হয়। এই মৈষাল বা মইষালদের কাছ থেকে ভাওয়াইয়া গানের সৃষ্টি। যার জন্য আজও ভাওয়াইয়া গান ভাঙ্গতি সুরে গাওয়া হয়। অনেকে বলেন ভাওয়াইয়া গানের আদি উৎপত্তি স্থল চীন-তিব্বত এলাকায় যা, পরবর্তীতে তরাই অঞ্চলে প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যার কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, ভাওয়াইয়া গানে তিব্বতী-চীনা ভাষার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আবার অনেকে মনে করেন ভাওয়াইয়ার জন্ম সেখানে নয় এমনো হতে পারে তিব্বতী-চীনা ভাষী কোনও পরিবার ভাওয়াইয়া গান প্রসারের কাজে লিপ্ত ছিল। যুক্তি হিসেবে তারা বলেছেন, ভাওয়াইয়া গানে এমন কিছু শব্দ বা বাক্য আছে যাতে তিব্বতী-চীনা ভাষা বিরাজমান। যেমন গেইলং, খাইলং, কইলং ইত্যাদি। নিম্নের গান দুটোতে আমরা দেখতে পাবো।
   প্রেম জানে না রসিক কালা চাদ কালা বুঝিয়া থাকে প্রাণ
   কত দিনে বন্ধুর সাথে হব দরিশন বন্ধু হে বন্ধুরে--
    নদী ওপারে তোমার বাড়ি যাইতে আসতে  অনেক দেরি
    হাটিয়া যাইতে নদীর পানি।
   থাকলাউ কি খুকলাং কি খাল্লাউ খাল্লাউ করেরে
    হায় হায় প্রাণের বন্ধুরে
অথবা
   গুর গুরিয়া ডাকে দেওয়া আইলো মরার ঝরি
   পতি গেইছে অমপুর শহর এ্যালাও না আইল বাড়িরে ও দেওয়া তোর পাও ধরংরে।
   বিয়ানে উঠি পতিধন মোর খালি পেটে গেইছে
   ভাত আন্দি মুই বসি আছোং
  ও তাই দিনম্যান ধরি রে
আবার অনেক সঙ্গীত বিশারদ মনে করেন যে, গান মানুষ মুখে মুখে রচনা করে বিভিন্ন সুরে মানুষের মাঝে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, তাহাই ভাওয়াইয়া। তারা কারণ হিসেবে বলেছেন, প্রাচীন গানগুলো যেভাবে বা যে সুরে গাওয়া হতো বা এখন হচ্ছে, সৃষ্ট সময় তার ভাষা, সুর, তাল, লয়, উপস্থাপনা আজকের মতো ছিল না। রচয়িতা যেভাবে রচনা করেছেন পরবর্তী গায়ক বা ধারক তার নিজের ইচ্ছা ও সুবিধা মতো গেয়ে গানটি প্রতিষ্ঠা করেছেন।

তথ্যসূত্রঃ প্রাণের সুর ভাওয়াইয়া
—খন্দকার মোহাম্মদ আলী সম্রাট 
 

Post a Comment

Previous Post Next Post