জলঘুঙুড়া —আমিনুর রাহমান রাজবংশী ভাষার ছোট গল্প

জলঘুঙুড়া
আমিনুর রাহমান

শ্যামলা বরণ কইনাখােনা । নম্বা নম্বা চুল । নাইকোলের পাতের নাখান ভুরু দুখনার মইদ্যে মইদ্যে , বাঁশির নাখান নম্বা নাক — তারে উপরা হলদিয়া এ্যাকনা ফোটা । কপাল থাকিয়া মুখ আর বুক উছলি পড়ে জোছনা । হাসিলে বুকের ভিতরা থাকি বিরি আইসে টিয়া রঙা মনখােনা । ঠোট নাল ডিবডিবা ফাগুন মাসিয়া কবিতা । কইনাখােনার নাম শ্যামলী । বি.এ.পাশ । কবিতা ন্যাকে । কোকিলার নাখান সুর ঢালিয়া , ঢলঢলা চোখ দুখনা ডেগর করিয়া , কাচাশাকের আগালির নাখান হেলিয়া দুলিয়া কবিতা পড়ে । কি সুন্দর হলপলা ! ঝায় শােনে , আঠাস হয়া যায় । কবি - সাহিত্যিক - লেখকের সােদে শ্যামলীর মাখামাখি , উঠা - বইসা । পত্র পত্রিকাত ন্যাকে,  অনুষ্ঠানত যায় । এ্যালা উনার ম্যালা বন্ধু বান্ধব । কিন্তু কবিতার সােদে উনার প্রেম কিশাের বেলার । কবিতা উনার আকাশ । মনের স্বপন । সুখ দুঃখ আহ্লাদ । দুই পাঙ্খ মেলিবার হাবিলাস । কবিতাক ছাড়িয়া উনায় বাঁচির পাবার নয় এ্যাক বেলাও । অবসরপ্রাপ্ত বাপ , মাও আর মলয় – -খুদরি সংসার । বউ ছাওয়া ধরি বড় দাদা ব্যাগল খায় । দিদির বিয়াও হইচে পাঁচ বছর আগােত । সংস্কৃতি প্রেমী মলয় , বই - খাতার দোকান করে । বুড়া বাপ দেখি শুনিয়া শ্যামলীক বৌমা করি আনিল । সেই থাকিয়া শ্বশুর - শাশুড়ির আদর যতন , আন্দন - বাড়ন – সংসারের সৌগ কাজ করে শ্যামলী হাসি মুখে । এ্যাকনা ব্যাটা উবজিচে । নাম থুইচে সুজ্জ । ঝনে শইষ্যার ফুল । বাপের নাখান গাও । কিন্তুক মুখ - চোখু দেখিলে মনে হয় গােটায়খান উমার মাও । ঠাকুমা আর ঠাকুরদার ছেয়া ছাড়ি নড়ে না । কোনােখান আবদার করিলে না করে কায় ! সুজ্জ বড় হয় । বাড়িটাত ভই ভইয়া হয় , শীতের দিনের গেন্দাফুলের নাখান । বিয়াও হবার আগে । শ্যামলী ভাবিছিলাে মলয় বােধায় । উনারে নাখান কবিতা ভালােবাসে । বিয়ার পর পথম পঙ্খম মলয়ের চোখুত নিন্দ নাই । এ আইত যায় , ও আইত পরে বিছিনাত উবুর হয়া শুতিয়া এ্যাখান এ্যাখান খাতার পাতা উল্টায় । শ্যামলীর কবিতা পড়ে । শ্যামলির গাও শিরশিরায় । বুকখান হিরহিরায় । মনের ভিতরা ঝিলমিল সায়রে ত্যাখন ঢেউয়ের দোলা । রঙের খেলা । খই ফোটা আকাশের তারালা খসি পড়ে টুপটাপ , টুপটাপ ! বাড়িত আসিচে মানী কবি লেখক । পিয়ন আসিয়া চিঠি , পত্র পত্রিকা দিয়া গেইচে । বগলা বগলি অনুষ্ঠানত শ্যামলী খায়া কবিতা পড়ি আসিচে । বুড়া শ্বশুরের কি আনন্দ । কিন্তু কোনঠে থাকি যে কি হইল , শ্বাশুড়ির মুখত বড় বৌয়ের গুণগান । ছােট বৌয়ের কথায় না শােনাে । পাইলে শলশনায় আর খুনখনায় । দোকান থাকি মলয় আসিলে বগল বয়েলা পুটুর পুটুর করে । মাও - ব্যাটার কান্ড দেখিয়া বুড়া বােবা ? ফ্যাল ফ্যাল করি চায়া রয় । শ্যামলী ফিক্কিস করি হাসে । নিশবদে কাজকামে ডুবি যায় । যে আকাশত এ্যাকদিন খই ফুটিছিল , তারে তলােত , মনের তিনভাগ নিলুয়া জল জুড়ি কি উথাল - পাতাল ! কুত্তি বা আস্তকে ঘুঙুড়া বাজে । জলঘুঙুরা । শ্যামলী খাতাত ন্যাকে ! কয়দিন পরে পিয়ন আসিয়া এ্যাখান চিঠি দিয়া যেইল । বুড়া শ্বশুর চিঠি পড়িয়া চিকরি চিকরি কয় – বৌমা ! আইসা অবিবার জলপাইগুড়িত কবিতার আসর । উত্তরবাংলার মানিক্কার কবিলা থাকিবে । তােমাক যাওয়ায় খাইবে । তােমার সােদো মুইও যাইম , মােক নিয়া যাইবেন ? এ্যাকে তাে অবিবার । দোকান বন্ধ । তার উপরা সুজ্জর ঘ্যানর ঘ্যানর আর জেদের কারণে বৌ ব্যাটাক ধরি মলয় নিজে গেইল জলপাইগুড়ি । বৌয়ের অনুষ্ঠান মােবাইলত একাদ করিছে । আইতােত বাড়ি আসিয়া মােবাইল চালে দেইল । এ্যাকে এ্যাকে বৌমার তিনখান কবিতা পড়া শ্যাষ হইল । কিন্তু কবি - দর্শক শােতার হাততালি আর ফুরায় নার বুড়ার কি আনন্দ । বৌমাক আদর করিয়া বগলত বসায় । বুড়ি ফৎকে উঠি ঘর থাকি হনহনে বিরি যায় । সুজ্জর মুখত খই ফুটির ধরিল । গােটায় দিন কি কি দেখিচে । কি কি খাইচে । কুত্তি কুত্তি বেড়াইচে — এ্যাক নিশ্বাসে সৌগ কয়া ঝাল্পে চড়িল ঠাকুরদার কোলাত । কতদিন পরে বুড়া মন ভরেয়া হাসিল ! শ্যামলী গিরগিরা দুধের আর এ্যাক কাপ চা আনিয়া দেইল শ্বশুরের হাতে । পরেরদিন সকালে নয় কি দশটার সময় , মলয়ের দিদি ফোন করিল বাপের বাড়িত — বাবা ! আজি খবরের কাগজ পড়িছিস ? বুড়া কয় কানে , কি হইছে । – ছয়ের পাতার উপরাত বামপাকে দ্যাখেক । গােট গােট করি মাওক পড়িয়া শােনাও । এাকবার পড়িছে । এবার ভাল করি উকটিয়া দ্যাখে বৌমার কোলাত সুজ্জ । বগলত খাড়া হয়া আছে মলয় হাসি মুখে । এ্যাকেবারে জলজ্যান্ত ছবি । নিজের ছবি দেখিয়া সুজ্জ ঝাপাইতে ঝাপাইতে যায়া মাক ডাকে আনিল আন্দন ঘর থাকিয়া । মুরাই খবর জুড়িয়া বৌমার প্রশংসা । সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বৌমা কি সােন্দং ইচ্ছে — কাও কাও কয় , বোমা কোনদিন বেটি না হয় । পরার বেটি । কিন্তুক মাের কাছাৎ শ্বশুর - শাশুড়ি - সােয়ামী ভালােবাসে মেক । উমার ভালােবাসা । পাইলে কবিতার বাদে মাের এ্যাতাে । ভালােবাসা কাটে থাকিল হয় । সেইবাদে মুই উমাক প্রণাম জানাই । বুড়া আঠাস হয়া যায় । হাতত কাগজ । মুখত রাও নাই । মাটির ভিতি চায় । বুড়ি আসিয়া কাগজখান হাতত নেয় । বোমার ছবির মাথা - গাও সােত্তায় ।। বোমার হাত দিয়া কয় – ন্যাও পড়ি দ্যাখো । মলায় আসিলে দ্যাখান । সেদিন মেলা আইতে সগায় নিন্দত পড়ি আছে । কবিতার খাতা , খবরের কাগজ গােটে থুইয়া শ্যামলী আয়নার আকপাকে খাড়া হয় তিপুষ্যানী দিনের কথা নােয়ায় , আজি খালি উনার রূপ - যৌবন জীবনের কবিতার কথা ফাম হয় । ভাল করি চোখুত চোখ থুইয়া দ্যাখে । পাছপাকে ওয়ালঘড়ির সৌগলা কাটা বারােটায় । ঘরােত । না । আয়নাত তার উল্টাং ভেন্টাৎ নাই । তাইলে সােয়ামীটা কানে এ্যামন হৈল । মলয় কানের বলত মুখ । আনিয়া কয় – মুই না হয় ভুল । করিচোং । তুই সেইটীয় মনত ধরি থাকিবু । শ্যামলীর দুই চোখ উথলি । ওঠে বুকের ভিতরা জলঘুঙুড়া বাজির নাগিচে । মলয় ওই বুকখান নিজের বুকত সাপটে ধরিয়া চোথুর জল মােছে দেয় । নিশাইর আতি , মলয় আজি কতদিন বাদে অমন কুসুম কুসুম শ্যামলীর কবিতার ছোঁয়া নাগে , নিম্ আকাশে তারা ফোটে ।

Post a Comment

Previous Post Next Post