রামকান্ত রায়ের রাজবংশী গল্প— বগা বগি

বগা বগি
রাম কান্ত রায় 

কুয়ার ব্যেঙোত সাগরােত ভাসে দিলে , কিবা জলের মাছােক শুকানােত তুল্লে যেটক দশা হয় , মােরে আজি ঐ - চক দশা । গােটায় বছর ইস্কুল পড়িবার বাদে থাকা খাওয়ার ঠিকঠাক করি ম্যেকউইলিয়াম ইস্কুলােত কেলাস সেভেনত ভর্তি করি দিয়া বাবা এলায় বাড়ি গেইল এই বাড়িটাত মােক থুইয়া । এই প্রথম মাের শহরােত আইসা । শহরের হাবভাব , চলন ফেরন , কতা কওয়া , মুই কিছুই জানােং না । কি করি কি করিম ? দিশাহারা হএ গেলুঙ । বাড়ি যাবার বাদে মন উড়াংবায়রাং করে । যে বাড়িটাত মােক থু গেইলেক উমরা বােল পূর্ব বাংলার মানষি । রাজশাহী জেলার । দেশভাগের সময় মােচলমানের পিট্টাও খাএা এইটে বাড়ি করিচে । এই জাগাটার নাম সুজ্জনগর । মাের ইস্কুলের বগলােত বাড়িটা । বাড়ির বুড়াটার নাম সতীশ দাস , হােমিওপ্যাথি ডাক্তারি করে । বুড়ার মাঈঞা আছে । ফির বুড়ার দুকুনা ব্যেটা , বড় বেটা শান্তি দাস , সেটেলমেন্ট অফিসােত চাকরি করে । তারাে মাঈএা আছে । ছাওয়া ছােটো হয়ে নাই । উকুন্দি । ছােটো ব্যেটা কান্তি দাস হালকিষ্যি করে । উনার মাঈঞা মরিসে একনা কৈনা ছােওয়া থুইয়া । ইমার আর একনা বাড়ি আছে খাগড়াত । মৈদ্দ্যত একনা নদী । বাঁশের চাঙরা দেওয়া কুল । বুড়ার বিধুয়া বেটি চারুবালা সাথােত নাতনি চৈতালি , ছছাটোবেলা হাতে দিদিমার সাথােত থাকে । বুড়ার আর একান বেটি মরি গেইছে , তারও বেটি ভক্তি , ইমারে এটি মানষি হবার ধরিছে । মাওবাপ নাইন মাওরিয়া । আর সাথােত থাকে একনা বুড়ি নাম ভুগি । উঙারাে কাঙোয় নাইন । বাচ্চাবেলা হাতে ইমারে এটি থাকে । খাগড়ার বাড়িতে কান্তি থাকে । কিছু হালের জমি কিনি চাষবাস করে । এই বাড়িত হাল চাষ করির বাদে দুইঝন মানষি রাখিছে । একঝনের নাম পরাণ আর ঐন্যঝন ডুকলু । ভাল মানষি । ধৈত্তে গেইলে দুই বাড়ি এক সংসার । কোনয় ভাগাভাগির ব্যেপার নাইন । যার যেটি থাকির ইচ্ছা থাকির পারে । এই বাড়িটাও কান্তি , ভুগিবাড়ি , কাজের মানসি দুইটা সব সময় থাকে । মুই ভক্তি আর প্রীতি ঐ বাড়িত থাকলেও বেশির ভাগ সময় এই বাড়িটাত থাকি । এই বছর মঙ্গা নাগি গেইল , চাউলের আকাল । রাত্তি করি নুটি খাওয়া নাইগবে । মােরতাে রুটি খাওয়ার আদত নাই । খুবে কষ্ট হবার নাগিচে । ছােটো দুইঝন — প্রীতি আর ভক্তি’র বাদে নাত্তি ভাত নান্দে । মাের রুটি খাবার কষ্টটা ভক্তি বুঝির পাইছে । ছলনা করি ভক্তি ডুগি মাসিক কৈলেক— “ মাসি মাের ভাতটা কান্তদাক দ্যেও , মাের রুটি ভাল লাগে । ' স্যেলা হাতে নাত্তি মাের ভাত খাওয়া জুটিল । একদিন সুজ্জনগর বাড়িটাতে মাের কাপুনি দিয়া ভাল্লুক জুর আসিল । ঠিক থাকির পাঙ না , গাত দুকুনা দাগিলা দিয়াও দলদলে কাপনি নাগিল । কোটে থাকি ভক্তি আসি গাত হাত দিয়া আটুশ কাড়াইল । হাউকু - দাউকু করি কপালােত জলপট্টি দিবার নাগিল । দাদুর থাকি হােমিওপ্যাথি বড়ি আনি খােয়ে দিলেক । মাথাটা হাত দিয়া মােচে দিবার নাগিল । জ্বরেরর ঘােরে সেই বাতে আঈওর নগুলের পরশ পাবার বাদে মনটা মাের চটফট করির নাগিল । খানেক বাদে মনে হৈলেক আঙ্গও আসি বুজি মাের কপালােত হাত দিবার নাগিচে । চকু মেলি দেখং না হয় মাের আঈ , সেটা হৈলেক ভত্তি । বুঝিলুঙ নারী রূপের কি অপার মহিমা । কোনবেলা বা চন্ডী রূপি মা কালী , কোনবেলা স্নেহময়ী জননী , কোনবেলা বা বান্ধবী । পরের দিন জুর সারিল । তখন থাকি ভক্তির উপরা একনা মায়া পড়িল । শনিবার হৈলে মনটা বাড়ির বাদে উরাং - বায়রাং করে । হাফ ইস্কুল করি বাড়ি যাঙ ! সমবার একেবারে ইস্কুল করি এই বাড়ি আইসাে । যেদিন বাড়ি যাঙ দেকির পাঙ ভক্তি জানেল দিয়া ঢুলকি মারি মাের ভিতি চাঞা রয় ।। বাড়ি হাতে আসিলে দৌড়ি আসি মাের হাত ধরি কৈবে — কাস্তদা , আজি রাত্তি কেটা মজার ঘটনা হৈছে । মুই কঙ– “ কি হৈচে ? উনায় কয়— ‘ আজি তাের না একনা স্বপন দেকিনু , একটা হলদিয়া পকি চালত পড়িচে , পকিটাক কাঙোয় ধরির না পাইলেক । তুই আসি পকিটাক ধরি মােরে হাত দিলু । নিল মাের ভাঙি গেইল । দিদিম মােক কয় , তুই উনার স্বপন দেখিস , প্রেমত পড়িস নাই তাে ? মুখখান মাের নাল হা যায় । মুই নৈজ্জায় পালা । সায় হাে হাে করি হাসি দেয় । ” পরের শনিবার বাড়ি গেনুং । বাড়িত আঈওর সােদে একে না কতা ওকেনা কতা বওয়ার পাছত কলুঙ , — “ আঈও , মুই যে বাড়িটাত থাকো সেটি এ্যকনা মাউরিয়া কৈনা থাকে তার নাম ভক্তি । কৈনা কোনা খুবে ভাল , উয়ার বাদে মাের ময়া পড়ি গেইচে । আঈয়াে কি - বা বুজিল জানােং না । মােক কৈলেক , - “ দেখ মাের সােনা বা বিদেশ বিভুই থাকিস খানেক সমঝিয়া চলিবু , কারাে সুদে ন্যাটোরপ্যাটোর না করিবু । আমার বংশােত কোনয় কেচ্ছা কাঙোয় করে নাই । কতাকোনা টিস টিস করি মনে রাখিস । পরের শনিবার আর বাড়ি যাঙ নাই খাগড়া বাড়িত আছে । গরু ভৈষলারগাও ধুবার বাদে নদি যামু । নদিত গাও বােয়া যাবে । ভক্তি কৈলেক— ‘ কান্তদা মুওি নদিত যাইম । পরানদা কৈলেক– তুই বেটি ছাওয়া মানষি নদিত ক্যা যাবু ? তাের মামা তােক নদি যাবার দিবেয় না । ভক্তি দৌড়ি কান্তিমামার ওটি যা ফ্যেকনা পাড়িল । মামা রাজি হঞা গেইল । মােক কৈলেক । ‘ তুই উনাক চউখে চউখে রাখিস । সাঁতার বােল না পায় । মামার হুকুম পাঞা ভক্তি আহ্লাদে আটখান । বন্ধ পিঞ্জিরার পঙ্খি ভালেদিন বাদে ছাড়া পাইলে যেনাকান হয় সেই নাকান হৈলেক । গরুভৈস সুদে সগায় মিলি নদি গেইলাে । পরানদা জলত নামি খ্যাড়ের ভুতা দিয়া গরুর গাও ধুয়া দিবার নাগিল । নদি একনা দ্বীপের নাকান , পাড়ত বগড়ি পাকি আছে । ভক্তি মাের গাত ঝাঙে চড়ি কয় , — “ মুই ওপার যাইম বগরি খাবার বাদে । ' অগত্যা কি করাে , পিটিত নিয়া একগালা জল পাড় করি উনাক ওপার নিয়া গেনু । নদি পাড় হবার সমায় ভক্তি মাের পিটিত উনার বুকখান ঘােচলেবার ধরিল । মােরপিট শিরশিরায় । ওপাড় যা খাড়া করি দেখং উনার গােটায় গাও ভিজি গেইচে । শরীলের সৌগে স্পষ্ট দেখা যাবার ধরিল । রূপ যৈবন উছলি পড়ির নাগিছে । বুঝিলুঙ উনায় এলা ভর গাবুর । বগড়ি ছিড়ি খাইতে আর জমাইতে আচমকা কি - বা হৈলেক ভংরিয়ার ঢক দু’কুনা ডেনা ধরি মাের চাইরাে পাকে ঘুরি মােক আছড়ে ফ্যালে দিয়া বুকখান সাপটে ধরি সিনেমার নায়ক নায়িকার ঢক করিল । ওপাড় হাতে পরানন্দা চিকরির ধরিসে — এই কান্ত , তােমরা । কোটে এতখােন কি করেন ? গােরুভৈস ঘাটা ধরিচে পচকরি আইসাে । কথাটা শুনি হুশ হৈলেক । ধরফর করি উটি কলুঙ , আসির ধচ্চি । ফির একে নাকান করি নদি পাড় করি আনিনুঙ ভক্তিক । ভাইল্লা বছর পরের কথা । মুই এ্যকনা রেলের চাকরি পাচুঙ । বিয়াও করিচুঙ । একনা কৈনা ছাওয়া হৈছে । মােটামুটি সংসার চলির ধরিচে । একদিন ডিউটি যা শুনির পালুঙ , একঝন মানযি কৈলেক , ‘ তাের ভক্তির কয়দিন আগত বিয়াও হৈছে । মামার বাড়ি নাইওর খাবার আসিচে । কতাকুনা শুনি বুকখান হাক্কাত করিল । মনে মনে ঠিক করিনুঙ কালি উনার ওটি যাইম । চারগচ সােনার চুরি কিনি ভক্তির দেখা করির বাদে গেনুঙ । মাের যাবার আগােতে উনায় বায়রা বাড়িত খাড়েয়া আছে । মােক দেকি ফ্যাল্লেত করি হাসি দিল । মুইও না কৈনার সাজ দেখি আটাশ খা গেনু । সিথিত সেন্দুর , কপালােত নাল ফোটা , গাত কতয় গহেনা । আগের থাকি কতয় সােন্দর । অনেকক্ষণ উনার ভিতি চাঞা রনু । উনায় কৈলেক ‘ কি দেখিস আয় ভিতিরা । দুইঝনে বিচিনাতে বসিলাে । মুই পুচিলুঙ , ‘ কোটে বিয়াও হৈল ? সােয়ামি কি করে ? উনায় কৈলেক , - দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুঘাটত বিয়াও হৈছে । সােয়ামি মাস্টারি করে । শুনি সুখী হনুঙ । কনুঙ , তাের সংসার সুখের হৌক আশুরবাদ করােঙ । তারপাচোত পকেট হাতে চুরি বির করি দিলু । উনায় চুরি হাতত নিয়া মােক একনা ভক্তি করি ফির মাের গালা জড়ে ধরি হুকহুকি কান্দির ধরিল । মুই উনার গাওমাথা সােত্তে দিলুঙ । মাের চখু দিয়াও জল আসিল । খানেক পরে উনার কি মনে হৈলেক মাের ঠেলি দিয়া হাত হাতে চুরি ফ্যালে দিয়া কৈলেক , ‘ এইল্লা তুই নিয়া যা মােরে এটে ক্যানে আসিলু তুই চলি যা । তুই মানষি নােয়াইস । তুই এটে হাতে চলি যা । ” মনের দুখে বিরি আসিনুঙ । মনত হৈলেক , তুই মােক ক্ষমা করি দিস ভক্তি । মুইতাে বগা । ফান্দত পড়ি বগা কান্দেরে । আজি বগাক দেকি বগি কান্দে আর বগিক দেকি বগা কান্দে ।

Post a Comment

Previous Post Next Post