সংকটের মুখে লোকশিল্প — হরিচন্দ্র দাস

সংকটের মুখে লােক শিল্প।
হরিচন্দ্র দাস

বিশ্ব ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা উনবিংশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লব তথা শিল্পায়ন । এই শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়েই মানবসভ্যতা আধুনিকযুগে পা রাখল, এ কথা বলতে। পারি। আর এই শিল্পবিপ্লব নিয়ে এল আধুনিক প্রযুক্তির হাত ধরে নানান সুখ আর ভােগের বিচিত্র প্রক্রিয়া। আধুনিক প্রযুক্তির হাত ধরেই গােটা বিশ্বকে একটি গ্রামে পরিণত করল এলাে বিশ্বায়ন বা নগরায়ন। তাই বলতে পারি বর্তমান যুগ বিশ্বায়নের যুগ, বর্তমানের যুগ নবায়নের যুগ। এই যুগ পরিবর্তনের মােহজালে তথা কড়াল গ্রাসে অরণ্যকেন্দ্রিক লােকসংস্কৃতি আজ সংকটের মুখে। প্রযুক্তি বিজ্ঞানের উন্নতিতে আমাদের জীবনে সময়কে যেমন বাঁচিয়েছে, তেমনি দূরকে করেছে নিকট। যার ফলে আমাদের হারাতে হয়েছে অনেক কিছুকেই। সুবিধাভােগী আলস্য মানুষ প্রযুক্তিবাদের কাছে ভােগবাদের দামে পরিণত হয়েছে, তেমনি হারিয়েছে তার সামাজিক, পারিবারিক, ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানকেও। যার জন্য আমাদের ঐতিহ্যগত লােক সংস্কৃতির লােক শিল্প সংকটের কবলে।   আধুনিক প্রযুক্তির চাপে বিশ্বায়নের কড়াল গ্রাসে আমাদের ঐতিহ্যগত গ্রাম্য লােকশিল্পগুলি আজ সংকটের মুখে। গ্রাম্য জীবনযাত্রার আমাদের ঐতিহ্যবাহী গরুরগাড়ী অন্যতম লােকশিল্প। একসময় গরুর গাড়ী ছিল যাতায়াতের একমাত্র বাহন। গরুর গাড়িতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেমন মাল নিয়ে যাওয়া হত, তেমনি গরুর গাড়িতে করে শুভযাত্রাও করা হত। গরুর গাড়িতে বিয়ে করতে যাওয়ার আনন্দের কথা আমরা মা-ঠাকুমা-দিদিমার কাছে শুনেছি; যা আমাদের কাছে রূপকথার গল্পের মতাে। আবার এই গরুর গাড়িকে কেন্দ্র করে কত গানও গাইত লােকশিল্পীরা। ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের পানে চায়ারে।' এই গাড়িয়াল সংগীত যেমন আজ সংকটের মুখে, তেমনি দূষণহীন গরুর গাড়ির জায়গায় দখল করে নিয়েছে পেট্রোল-ডিজেল চালিত ইঞ্চিনের মােটরগাড়ি; যা আমাদের সবুজ পরিবেশকে দূষিত করছে। এ যেন। মানুষের প্রয়ােজনের কাছে, জীবনচর্চার কাছে, দৃষ্টিভঙ্গির কাছে লােক শিল্পের পরাজয়। এইরকম কয়েকটি লােকশিল্পের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি যা আধুনিক প্রযুক্তির কাছে, বিশ্বায়নের প্রভাবে সংকটের মুখে। | বাঙ্গালির রান্না-বান্নায় বাঙালিকে চেনা যায়। বিশ্বের সকল জাতি স্বীকার করে বাঙালি রান্না-বান্নায় পটু। যেখানে রান্না হয় তা সাধারণত রান্নাঘর বা পাঘর বা রসুইঘর, বা রন্ধনঘর (আন্ধনঘর) নামে পরিচিত। এই রান্নাঘরের অন্যতম লােক শিল্পটি হল মশলাবাটা তথা শিলনােড়া। এই শিল-নােড়ার প্রচলন বাঙালি জাতির জন্মকাল থেকেই রান্নার যাবতীয় মশলা শিল-নােড়ায় বেটে রান্নার উপযােগী করার প্রচলন অনাদীকাল থেকেই। সচরাচর শিলনােড়ায় মশলা বাটা হওয়ার ফলে, শিল-নােড়ার ঘর্ষণে শিল-নােড়ার ধার কমে গিয়ে মসৃণ হয়ে পড়ে। আবার তখন দরকার হয় শিল- নােড়াকে খােদাই করার । আর এই খােদাই বা ধার করার কাজ করে অনেক লােকশিল্পীই জীবিকা নির্বাহ করে ক্লান্ত দুপুরে রৌদ্রে পাড়ায় পাড়ায় শােনা যায় নাে গােটানিদের হাঁক শিল কাটাৱে গাে-ও-ও। বর্তমানে এই হাক আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে। | এই শিল-কোটানিকে কেন্দ্র করে অনেকে সংসার চালনা করলেও এর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে শিল-কোটানির শিল্প মানসিকতা। এই লােক শিল্পীরা ছােট লােহার ছেনি ও হাতুরি দিয়ে বিভিন্ন লতাপাতা, মাছের ছবি এঁকে সৌন্দর্যে ভরে তুলত শিল নােড়ার মসৃণ দেহ। যেখানে নিখুঁতভাবে কাজ করত শিল্পীমন। এটাও তাই এক প্রকার লােকশিল্প। যা লােকসংস্কৃতির এক উজ্জ্বল সৃষ্টি। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যার চাপে, বিশ্বায়নের কড়াল গ্রাসে শিল-নােড়ার প্রচলন প্রায় সংকটের মুখে। এখন হাতের কাছে গৃহিনী পেয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন রকমারী গুড়াে মশলার প্যাকেট এবং শিল নােড়ার বদলে পেয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন রকমের মিক্সার মেশিন । সময়কে বাঁচাতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে গুড়াে মশলা ও মিক্সার মেশিনের প্রতি গিন্নীরা আগ্রহী হয়ে উঠছে। আর যার জন্যই বাঙালির রান্নাঘর থেকে বিদায় নিচ্ছে শিল-নােড়া। আবার শিল নােড়ার বসে মশলা বাটায় গৃহিনী। যেমন একপ্রকার ব্যায়াম চর্চা হত; তেমনি বর্তমানে গৃহিনী সুবিধাভােগী হতে গিয়ে বিভিন্ন রােগের সম্মুখীন হচ্ছে। এখানে যেমন লােক-শিল্পীটির অপমৃত্যু ঘটেছে, তেমনি লােক সংস্কৃতির অঙ্গ লােক শিল্পটিরও সংকটের মুখে পতিত হচ্ছে। আবার শিল-নােড়া কোটানােকে কেন্দ্র করে লােকশিল্পের হৃদয়ের গানও বিদায় নিচ্ছে। লােক শিল্পের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল— গ্রাম বাংলায় ব্যবহৃত চেঁকি। গ্রাম বাংলার সংসার জীবনে কেঁকির স্থান উচ্চে। গ্রাম বাংলার মা-পিসিমা- মাসিমা-ঠাকুমারা ভাের বেলায় উঠে ধান ভাঙে, চাললাে হলুদ ইত্যাদি গুড়া করে। পেঁকিছাটা চালের ভাত কতটা সুগন্ধ ও ভিটামিনযুক্ত তা না খেলে বােঝাই যায় না। প্রবাদে আছে- ধান ভাঙতে শিবের গীত।' টেকিতে ধান ভাঙাকে কেন্দ্র করে বহু গীত। হয়েছে। এখানে পেঁকি আর টেকি চালক যখন কথা বলে— – পেঁকিরে ভাই, কি করে ভাই? চেঁকি কেন কান্দে? – বউ ভাত রান্দে'। এখানে যেন আমরা খুঁজে পাই গৃহস্থের সঙ্গে গৃহস্থ বউয়ের সম্পর্ক। উেঁকি যেন গহস্থ মানুষ, আর টেকি চালক যেন গৃহস্থের বউ। চেঁকিতে ধান ভাঙলে- সেই চাল দিয়েই গহিনী ভাত রান্না করে। তাই গ্রাম্য সংসারে চেঁকি ও টেকি চালকের এক আত্মীকা সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু এই আত্মকি সম্পর্ক আজ সংকটের মুখে। প্রবাদ বলে চেঁকি স্বগে গেলেও ধান ভাঙে। সত্যি চেঁকি যেন সত্য থেকে স্বর্গে বিদায় নিয়েছে, যার ব্যবহার গ্রাম বাংলায় আজ আর প্রায় নেই। সেখানে দখল করে বসেছে আধুনিক ধান ভাঙার ও চালগুড়াে করার মেশিন। গতিশীল জীবনযাত্রায় টেকি আজ অচল । টেকিতে ধান ভাঙা। হলেও এই ঢেঁকিকে কেন্দ্র করে লােক শিল্পীরা বিভিন্ন গীত রচনা করেন – যেখানে প্রাণের সম্পর্ক রয়েছে; আবার মা-মাসিমা-পিসিমা-ঠাকুরমা যখন ভােরবেলায় ওঠে টেকি চালনা করে— তখন ভােরের হাওয়া যমন তাদের শরীর ও মনকে সতেজ রাখে, তেমনি টেকি চালনার তালে তালে একপ্রকার ব্যায়ামও হয়ে যায় । কিন্তু ধান ভাঙার আধুনিক বিকল্প মেশিন আবিস্কার হওয়ায় মানুষ যেমন অচল হয়ে পড়েছে, তেমনি পরিবেশও দূষিত হচ্ছে; সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে ঐতিহ্যগত লােকসংস্কৃতির লােকশিল্প পেঁকি। আলপনা লােকশিল্পের আর একটি বিষয়। এই আল্পনা আমাদের, বিশেষত বাঙালির অতিপ্রাচীন ঐতিহ্য। বাড়ির শুভকর্মে আল্পনা ব্যবহার বহুকালের। মায়ের যত্নে সঙ্গে সুপ্ত শিল্পীর মনের দরজা খােলে বাড়ির উঠানে, ঘরের মেঝেতে বিভিন্ন সৌকর্যে আলপনা আঁকতেন । কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যায় ও বিশ্বায়নের কড়াল গ্রাস থেকে এই লােকশিল্পটিও রেহাই পায়নি। আমরা মানছি আলপনা চিত্রকে কেউ কেউ পেশা হিসেবে গ্রহণ করছেন। কিন্তু বর্তমানে এই লােকশিল্পটিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে আধুনিক নানান আঙ্গিক যেমন ব্যবহার করেছেন তেমনি নানান উপকরণও ব্যবহার করেছেন। যার সমস্যাটা দাড়িয়েছে-লােকসংস্কৃতি ও লােকশিল্পের বিশুদ্ধত বিনষ্ট। আমরা তাে জানি, লােকশিল্প লােকশিল্পীর স্বতন্ত্র চিন্তাভাবনার ফসল, সেখানে আধুনিক চাকচিক্যময় প্রযুক্তি ব্যবহার লােকশিল্পী তার স্বতন্ত্র শিল্পীসত্তাকে হত্যা করছে। আর এখানেই লােকশিল্প আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার ফান্দে পড়ে তার নিজস্বতা হারাচ্ছে। এভাবে বিশ্বায়নের যুগে আধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যার কড়াল গ্রাসে পড়ে আমাদের ঐতিহ্যগত গ্রাম্য লােকসংস্কৃতির লােক শিল্পগুলি আজ সংকটের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। লােকশিল্পের সঙ্গে লােক সমাজের যে আত্মিক সম্পর্ক, শিকড়ের টান তা আজ বিনষ্ট হচ্ছে। আমরা হারাতে বসেছি আমাদের অতীত ঐতিহ্যকে, তেমনি অতীতকে হারাতে গিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির কড়াল গ্রাসে পড়ে প্রাণহীন হয়ে যাচ্ছি, দিন দিন দিশেহারা হয়ে আমরা যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি। এই মহাসংকট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লােকশিল্পীরা যেমন লােকশিল্পকে বর্তে রাখার জন্য এগিয়ে আসবেন, তেমনি সংস্কৃতির ধারকবাহক বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কেও এগিয়ে আসতে হবে। আর এক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কেও সর্বদাই মনে রাখতে হবে—
‘নগর পুড়িলে দেবালয় কী এড়ায়।'

সহায়ক গ্রন্থ :
(ক) বাংলা লােকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ- সম্পাদক, দুলাল চৌধুরী
(খ) লােকসংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ- সুকান্ত পাল।
(গ) পশ্চিমবঙ্গ- জলপাইগুড়ি সংখ্যা

লেখক: পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

Post a Comment

Previous Post Next Post